ওই সময় বঙ্কিমের বিরুদ্ধ-আলোচনা হলে তার কিঞ্চিৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং ফলে, এর মধ্যে একজন ঠাকুরবাড়িতে কাজ করতেন বলে বঙ্কিম লেখেন, শুনিয়াছি ইনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর মহাশয়দিগের একজন ভূত– নাএব কি কি আমি ঠিক জানি না। অথচ দ্বিজেন্দ্রনাথ যখন আমার মনে হয় অনিচ্ছায়–বঙ্কিম সম্বন্ধে আলোচনা করেন তখন বঙ্কিম গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, তত্ত্ববোধিনীতে নব্য হিন্দু সম্প্রদায় এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধে আমার লিখিত ধর্ম-জিজ্ঞাসা সমালোচিত হয়। সমালোচনা আক্রমণ নহে। এই লেখক বিজ্ঞ, গম্ভীর এবং ভাবুক। আমার যাহা বলিবার আছে, তাহা সব শুনিয়া যদি প্রথম সংখ্যার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করিয়া (বঙ্কিমের রচনাটি ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হচ্ছিল–লেখক) তিনি সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইতেন, তবে তাহার কোনও দোষই দিতে পারিতাম না। তিনি যদি অকারণে আমার উপর নিরীশ্বরবাদ প্রভৃতি দোষ আরোপিত না করিতেন,(১০) তবে আজ তাঁহার প্রবন্ধ এই গণনার ভিতর (অর্থাৎ যারা বঙ্কিমের প্রতিবাদ করেন, নগণ্য অর্থে নয় –লেখক) ধরিতে পারিতাম না। তিনি যে দয়ার সহিত সমালোচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি আমার ধন্যবাদের পাত্র। বোধহয় বলায় দোষ নাই যে, এই লেখক স্বয়ং তত্ত্ববোধিনী সম্পাদক বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমি জানি আমার কথায় কেউ বিশ্বাস করবেন না, তাই আমি এঁর সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণার উল্লেখ করলুম। বস্তৃত বাঙলা দেশের এই উনবিংশ শতকের শেষের দিক (ফঁ্যা দ্য সিএল) যে কী অদ্ভুত রত্নগর্ভা তা আজকের দিনের অবস্থা দেখে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়।
আমি সে আলোচনা এস্থলে করতে চাই নে। আমি শুধু নব্যসম্প্রদায়ের মধ্যে যারা তত্ত্বানেষী তাদের দৃষ্টি দ্বিজেন্দ্রনাথের দিকে আকৃষ্ট করতে চাই।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি প্রায় এক বত্সর তার সখা সিংহ পরিবারের সঙ্গে রাইপুরে কাটান। তার পর ১৯০৭-এর কাছাকাছি শান্তিনিকেতন আশ্রমের বাইরে (এখন রীতিমতো ভিতরে এসে আমৃত্যু (১৯২৬) বসবাস করেন। কলকাতার সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। এখানে তিনজন লোক তার নিত্যালাপী ছিলেন, স্বৰ্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন ও রেভরেন্ড এন্ড্রুজ। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রায়ই ভুলে যেতেন যে রবীন্দ্রনাথের বয়সও ষাট পেরিয়ে গেছে (আমি শেষের পাঁচ বত্সরের কথা বলছি। স্বচক্ষে যা দেখেছি) এবং শাস্ত্রীমশাই যদি দ্বিজেন্দ্রনাথের কোনও নতুন লেখা শুনে মুগ্ধ হয়ে বলতেন, এটি গুরুদেবকে দেখাতেই হবে, তখন তিনি প্রথমটায় বুঝতেনই না, গুরুদেব কে, এবং অবশেষে বুঝতে পেরে অট্টহাস্য করে বলতেন, রবি রবি তো ছেলেমানুষ! সে এসব বুঝবে কি তুলে যেতেন, বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। আবার পরদিনই হয়তো বাঙলা ডিফথং সম্বন্ধে কবিতায় একটি প্রবন্ধ (!) লিখে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথকে। চিরকুটে প্রশ্ন, কীরকম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কী উত্তর দিতেন সেটি পাঠক খুঁজে দেখে নেবেন।
শিশুর মতো সরল এই মহাপুরুষ সম্বন্ধে সে যুগে কত লেজেন্ড প্রচলিত ছিল তার অনেকখানি এখনও বলতে পারবেন শ্ৰীযুত গোস্বামী নিত্যানন্দবিনোদ, আচার্য নন্দলাল, আচার্য সুরেন কর, বন্ধুবর বিনোদবিহারী, অনুজপ্রতিম শান্তিদেব, উপাচার্য সুধীরঞ্জন। দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দীপেন্দ্রনাথ তারই জীবদ্দশায় গত হলে পর তিনি নাকি চিন্তাতুর হয়ে পুত্রের এক সখাকে জিগ্যেস করেন, তা দীপু উইল-টুইল ঠিকমতো করে গেছেন তো? এ গল্পটি বলেন শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত ও উপাচার্য শ্ৰীযুত সুধীরঞ্জন। সুধীরঞ্জন চিফ-জাস্টিস ছিলেন বলে আইনের ব্যাপারে দ্বিজেন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা স্বতই তার মনে কৌতুকের সৃষ্টি করে এবং গল্পটি বলার পর তিনি বিজ্ঞভাবে গম্ভীর হয়ে চোখের ঠার মানেন।
তার অকপট সরলতা নিয়ে যেসব লেজেন্ড (পুরাণ) প্রচলিত আছে সে সম্বন্ধে একাধিক আশ্রমবাসী একাধিক রসরচনা প্রকাশ করেছেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সামান্য। একবার আমার হাতে একটি সুন্দর মলাটের পাতা দেখে শুধোলেন, এটা কোথায় কিনলে? আমি বললুম, কোপে। সে আবার কী? আমি বললুম, কো-অপারেটিভ স্টোর্সে। তিনি উচ্চহাস্য(১১) (এ উহাস্য কারণে অকারণে উসিত হত এবং প্রবাদ আছে দেহলীতে বসে গুরুদেব তাই শুনে মৃদুহাস্য করতেন) করে বললেন, ও! তাই নাকি! তা কত দাম নিলে? আমি বললুম, সাড়ে পাঁচ আনা। আমি চলে আসবার সময় একখানা চিরকুট আমার হাতে দিলেন। তাতে লেখা ছিল, বউমা (কিংবা ওই ধরনের সম্বোধন, আমাকে তুমি (কিংবা আপনি, তিনি কখন কাকে আপনি কখন তুমি বলতেন তার ঠিক থাকত না–তুই বলতে বড় একটা শুনিনি) সাড়ে পাঁচ আনা পয়সা দিলে আমি একখানা খাতা কিনি। তার পুত্রবধূ তখন বোধহয় দু-একদিনের জন্য উত্তরায়ণ গিয়েছিলেন।
তার এক আত্মীয়ের মুখে শুনেছি, একবার বাম্পা-ক্রপ হলে পর সুযোগ বুঝে পিতা মহর্ষিদেব তাঁকে খাজনা তুলতে গ্রামাঞ্চলে পাঠান। গ্রামের দুরবস্থা দেখে তিনি নাকি তার করলেন, সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড। (তার গ্রামোন্নয়ন করার বোধহয় বাসনা হয়েছিল। উত্তর গেল, কাম ব্যাক!