অনেকের সম্বন্ধেই বেখেয়ালে বলা হয়, অমুকের বহুমুখী প্রতিভা ছিল। আমি বলি সত্যকার বহুমুখী প্রতিভা ছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের। বিজ্ঞান ও দর্শন উভয়েরই চর্চা করেছেন তিনি সমস্ত জীবন ধরে। রবীন্দ্রনাথ তার গণিতচর্চা বিদেশে প্রকাশিত করার জন্যে উত্সাহী ছিলেন, কিন্তু বড়দাদা বিশেষ গা-করেননি।(৬) এদেশের অত্যল্প লোকই এযাবৎ গ্রিকলাতিনের প্রতি মনোযোগ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ গ্রিকলাতিনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে শব্দতত্ত্বে সংস্কৃত উপসর্গ, তথা মুখুয্যে, বড়য্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে তার সুদীর্ঘ রচনা অতুলনীয়। কঠিন, অতিশয় কঠিন পাঠককে সাবধান করে দিচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটারও উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করি যে, এরকম কঠিন জিনিস এর চেয়ে সরল করে স্বয়ং সরস্বতীও লিখতে পারতেন না।
আমার যতদূর জানা, খাঁটি ভারতীয় পণ্ডিতের ন্যায় ইতিহাসকে তিনি অত্যধিক মূল্য দিতেন না–ইতিহাস পের সে, বাই ইটসেল। অথচ পরিপূর্ণ অনুরাগ ছিল ইতিহাসের দর্শন-এর (ফিলসফি অব হিস্ট্রির প্রতি।
সাহিত্য ও কাব্যে তার অধিকার কতখানি ছিল সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অভিমত পূর্বেই উদ্ধৃত করেছি। বিশেষ বয়সে তিনি খাঁটি কাব্য রচনা বন্ধ করে দেন। কিন্তু দর্শন ছাড়া যে কোনও বিষয় রচনা করতে হলে (যেমন শব্দতত্ত্ব বা রেখাক্ষর বর্ণমালা অর্থাৎ বাংলায় শর্টহ্যান্ড) মিল, ছন্দ ব্যবহার করে কবিতারূপেই প্রকাশ করতেন। বস্তৃত কঠিন দর্শনের বাদানুবাদ ভিন্ন অন্য যে কোনও ভাবানুভূতি তার হৃদয়মনে সঞ্চারিত হলেই তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হত সেটি কবিতাতে প্রকাশ করার। এবং তাতে যদি হাস্যরসের কণামাত্র উপস্থিতি থাকত, তা হলে তো আর কথাই নেই।
নিচের একটি সামান্য উদাহরণ নিন :
তারই নামে নাম, অধুনা অর্ধবিস্মৃত, কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (বরঞ্চ ডি, এল. রায় বললে আজকের দিনের লোক হয়তো তাকে চিনলে চিনতেও পারে) একদা তদীয় গণ্যমান্য বিখ্যাত ও অব্যাত বই বন্ধু-বান্ধবকে একটা বিরাট ভেজে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। এই উপলক্ষে তাহার যে আহ্বান-লিপি জারি হইয়াছিল তাহা এস্থলে অবিকল মুদ্রিত করিয়া দিতেছি।
যাহার কুবেরের ন্যায় সম্পত্তি, বৃহস্পতির ন্যায় বুদ্ধি, যমের ন্যায় প্রতাপ এ হেন যে আপনি, আপনার বনের নন্দনকানন ছাড়িয়া, আপনার পদ্মপলাশবনা ভামিনী-সমভিব্যাহারে (sic), আপনার স্বর্ণশকটে অধিরূঢ় হইয়া, এই দীন অকিঞ্চিৎকর, অধমদের গৃহে, শনিবার মেঘাচ্ছন্ন অপরাহ্নে আসিয়া যদি শ্রীচরণের পবিত্র ধূলি ঝাড়েন–তবে আমাদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়। ইতি,
শ্রীসুরবালা দেবী
শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
শ্রীজিতেন্দ্রনাথ মজুমদার।(৭)
এর উত্তরে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখলেন,
ন চ সম্পত্তি ন বুদ্ধি বৃহস্পতি,
যমঃ প্রতাপ নাহিক মে।
ন চ নন্দনকানন স্বর্ণসুবাহন
পদ্মবিনিন্দিত পদযুগ মে।
আছে সত্যি পদরজরত্তি।
তাও পবিত্র কে জানিত মে
চৌদ্দপুরুষ তব ত্রাণ পায় যদি,
অবশ্য ঝাড়িব তব ভবনে।
কিন্তু মেঘাচ্ছনে শনি অপরাহ্নে
যদি গুরু বাধা না ঘটে মে।
কিম্বা (sic) যদ্যপি সহসা চুপিচুপি
প্রেরিত না হই পরধামে।(৮)
গুরুজনদের মুখে এখানে গুনেছি যে সময় তিনি এই মিশ্র সংস্কৃতে নিমন্ত্রণপত্রের উত্তর দেন তখন তিনি গীতগোবিন্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন বলে ওই ভাষাই ব্যবহার করেন। কেউ কেউ বলেন, জয়দেবই প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষার কাঠামো তৈরি করে দিয়ে যান। তাই দ্বিজেন্দ্রনাথের উত্তরও শেষের দিকটি বাঙলায়। আবার কোনও কোনও গুরুজন দ্বিতীয় ছত্রটি পড়েন, ন চ নন্দনকানন স্বর্ণসুবাহন পদ্মপলাশলোচনভামিনী মে।
কবিতাতে সবকিছু প্রকাশ করার আরও দুটি মধুর দৃষ্টান্ত দিই।
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষেধ ছিল। একদিন দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাতভ্রমণের সময় দূর হতে দেখতে পান, হেডমাস্টার জগদানন্দ রায় একটি ছেলের কান আচ্ছা করে কষে দিচ্ছেন। কুটিরে ফিরে এসেই তাঁকে লিখে পাঠালেন।
শোনো হে, জগদানন্দ দাদা,
গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব
অশ্বে পিটিলে হয় যে গাধা—
গাধা পিটলে ঘোড়া হয় না–এটা আমাদের জানা ছিল, কিন্তু ঘোড়াকে পিটলে সেটা গাধা হয়ে যায় এটি দ্বিজেন্দ্রনাথের অবদান। এরসঙ্গে আবার কেউ কেউ যোগ দিতেন,
শোন হে জগদানন্দ,
তুমি কি অন্ধ!
এটির লিখিত পাঠ নেই। তাই নির্ভয়ে উদ্ধৃত করলুম। এর পরেরটি কিন্তু ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটে বেরিয়েছে। এরমধ্যে ভুল থাকলে গবেষক সেটি অনায়াসে মেরামত করে নিতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথের ৬৫ বৎসর বয়স হলে তিনি ভোরবেলা চিরকুটে লিখে পাঠালেন :
চমৎকার না চমৎকার।
সেই সেদিনের বালক দেখো,
পঞ্চষট্টি হল পার।
কাণ্ডখানা চমৎকার,
চমৎকার না চমৎকার!
পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ততদিন কলকাতাতেই ছিলেন। মোটামুটি বলা যেতে পারে, ১৮৭০ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় বিদ্বজ্জনসমাজের চক্রবর্তী ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম তিনি ধর্মের স্মৃতিশাস্ত্রটুকু ব্যবহার করেছেন মাত্র; মোক্ষপথ-নির্দেশক ধর্ম ও দর্শনে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল না) ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করতেন না বলে সে যুগের অন্যতম চক্রবর্তী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের নিত্যালাপী প্রায়ই ঠাকুরবাড়িতে এসে তার সঙ্গে তত্ত্বালোচনা করে যেতেন।(৯)