আমি এ জীবনে দুটি মুক্ত পুরুষ দেখেছি; তার একজন দ্বিজেন্দ্রনাথ।
এঁর জীবন সম্বন্ধে কোনওকিছু জানবার উপায় নেই। তার সরল কারণ, তার জীবনে কিছুই ঘটেনি। যৌবনারম্ভে বিয়ে করেন, তার পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা। যৌবনেই তিনি বিগতদার হন। পুনর্বার দারুগ্রহণ করেননি।(১) চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ শ্ৰীযুত সৌম্যেন্দ্রনাথ এদেশে সুপরিচিত। দুঃখের বিষয় সুধীন্দ্রনাথের স্থায়ী কীর্তিও বাঙালি পাঠক ভুলে গিয়েছে।
দ্বারকানাথ যে যুগে বিলেত যান সে-সময় অল্প লোকই আপন প্রদেশ থেকে বেরুত। তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ তো প্রায়শ বাড়ির বাইরে বাইরে কাটাতেন। ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথের তো কথাই নেই। তাই স্বতই প্রশ্ন জাগবে, ইনি কতখানি ভ্রমণ করেছিলেন।
একদা কে যেন বলেছিলেন, বাংলায় মন্দাক্রান্ত ছন্দে লেখা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে তিনিই লিখে দিলেন :
ইচ্ছা সম্যক জগদরশনে(২) কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিক্লি মন উড়ু উড়ু এ কি দৈবের শাস্তি!
টঙ্কা দেবী করে যদি কৃপা না বহে কোনও জ্বালা।
বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না শুধু ভস্মে ঘি ঢালা। (৩)
চারটি ছত্রের চারটি তথ্যই ঠাট্টা করে লেখা। কারণ আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনিনি, বড়বাবুর (দ্বিজেন্দ্রনাথের) বেড়াবার শখ ছিল। বরঞ্চ শুনেছি, তার প্রথম যৌবনে তাঁর পিতা মহর্ষিদেব তার বিদেশ যাবার ইচ্ছা আছে কি না, শুধিয়ে পাঠান এবং তিনি অনিচ্ছা জানান। পাথেয় নাস্তি কথাটারও কোনও অর্থ হয় না; দেবেন্দ্রনাথের বড় ছেলের টাকা ছিল না, কিংবা কর্তা গত হওয়ার পরও হাতে টাকা আসেনি, এটা অবিশ্বাস্য।
আমার সামনে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি তা হলে নিবেদন করি। ১৩৩১-এর ১লা বৈশাখের সকালে রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে উপাসনা সমাপন করে যথারীতি সর্বজ্যেষ্ঠের পদধূলি নিতে যান। সেবারে ওই ১লা বৈশাখেই বোঝা গিয়েছিল, বাকি বৈশাখ এবং বৃষ্টি না নামা পর্যন্ত কীরকম উৎকট গরম পড়বে। প্রেসের পাশের তখনকার দিনের সবচেয়ে বড় কুয়োর জল শুকিয়ে গিয়ে প্রায় শেষ হতে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ তার সর্বাগ্ৰজকে বললেন যে, এবারে গরম বেশি পড়বে বলে তিনি হিমালয়ের ঘুমে বাড়ি ভাড়া করেছেন, বড়দাদা গেলে ভালো হয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বড়বাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, আমি আমি আমার এই ঘর-সংসার নিয়ে যাব কোথায়? যে সব গুরুজন আর ছেলেরা গুরুদেবের সঙ্গে গিয়েছিলেন তারা একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছিলেন। হয়তো-বা মুখ টিপে হেসেও ছিলেন। তার ঘর-সংসার! ছিল তো সবে মাত্র দু-একটি কলম, বাক্স বানাবার জন্য কিছু পুরু কাগজ, দু-একখানা খাতা, কিছু পুরনো আসবাব! একে বলে ঘর-সংসার! এবং তার প্রতি তার মায়া! জীবনস্মৃতির পাঠক স্মরণে আনতে পারবেন, নিজের রচনা, কবিতার প্রতি তার কী চরম ঔদাসীন্য ছিল!(৪) লোকমুখে শুনেছি সকলের অজান্তে এক ভিখিরি এসে তার কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি বললেন, আমার কাছে তো এখন কিছু নেই। তুমি এই শালখানা নিয়ে যাও। প্রাচীন যুগের দামি কাশ্মিরি শাল। হয়তো-বা দ্বারকানাথের আমলের। কারণ তার শালে শখ ছিল। ভিখিরি প্রথমটায় নাকি নিতে চায়নি! শেষটায় যখন বড়বাবুর চাকর দেখে বাবুর উরুর উপর শালখানা নেই, সে নাতি দিনেন্দ্রনাথকে (রবীন্দ্রনাথের গানের ভারী) খবর দেয়। তিনি বোলপুরে লোক পাঠিয়ে শালখানা কিনিয়ে ফেরত আনান। ভিখিরি নাকি খুশি হয়েই বিক্রি করে; কারণ এরকম দামি শাল সবাই চোরাই বলেই সন্দেহ করত। কথিত আছে, পরের দিন যখন সেই শালই তার উরুর উপর রাখা হয় তখন তিনি সেটি লক্ষ করলেন না যে এটা আবার এল কী করে!
আবার কবিতাটিতে ফিরে যাই। পায়ে শিকলি, মন উড়ু উড়ু আর যার সম্বন্ধে খাটে খাটুক, দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে খাটে না! এরকম সদানন্দ, শান্ত-প্রশান্ত, কণামাত্র অজুহাত পেলে অট্টহাস্যে উচ্ছ্বসিত মানুষ আমি ভূ-ভারতে কোথাও দেখিনি। আমার কথা বাদ দিন। তাঁর সম্বন্ধে বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, হরিচরণ যা লিখে গেছেন সে-ই যথেষ্ট। কিংবা শ্ৰীযুত নন্দলালকে জিগ্যেস করতে পারেন।
টঙ্কা দেবী করে যদি কৃপা– ও বিষয়ে তিনি জীবন্মুক্ত ছিলেন।
আর সবচেয়ে মারাত্মক শেষ ছত্রটি! তার বিদ্যাবুদ্ধি কিছু না কিছু না বললে কার যে ছিল, কার যে আছে সেটা জানবার আমার বাসনা আছে। অবশ্য সাংসারিক বুদ্ধি তার একটি কানাকড়িমাত্রও ছিল না। কিন্তু সে অর্থে আমি নেব কেন? বুদ্ধি বলতে সাংখ্যদর্শনে যে অর্থে আছে সে অর্থেই নিচ্ছি যে গুণ প্রকৃতির রজঃ তম গুণের জড়পাশ ছিন্ন করে জীবকে পুরুষের উপলব্ধি লাভ করতে নিয়ে যায়।(৫) তার বিদ্যা সম্বন্ধে পুনরাবৃত্তি করে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথ একদিন আমাদের বলেন, তিনি জীবনে দুটি পণ্ডিত দেখেছেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং তাঁর বড়দাদা; কিন্তু রাজেন্দ্রলাল পণ্ডিত ইয়োরোপীয় অর্থে। তাঁর বড়দাদা কোন অর্থে, কবি সেটি বলেননি। এবং খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা যেন না ভাবি তার বড়দাদা বলে তিনি একথা বললেন।
বর্তমান লেখকের বিদ্যাবুদ্ধি উভয়ই অতিশয় সীমাবদ্ধ। তবে আমারই মতো অজ্ঞ একাধিকজনের জানবার বাসনা জাগতে পারে আমি কাদের পণ্ডিত বলে মনে করি। আমি দেখেছি দুজন পণ্ডিতকে, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ইয়োরোপবাসের পরও।