পাহাড়ের উপর থেকে রমনাশ্রম, দ্রৌপদী-মন্দির সবকিছুই খুব ছোট দেখাচ্ছিল। তার পর নামবার সময় পাহাড়ের সানুদেশে এক জায়গায় খুব সোজা এবং বেশ ঢালু পথ পাওয়ায় আমি ছুটে সেই পথ দিয়ে নামতে আরম্ভ করলুম এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলুম, আশ্রম, দ্রৌপদী-মন্দির কীরকম অদ্ভুত দ্রুতগতিতে বৃহৎ আকার ধারণ করতে লাগল।
আমার এ অভিজ্ঞতা থেকে এটা কিছু প্রমাণ হয় না যে, পৃষ্পক রথ কল্পনার সৃষ্টি কিংবা রমন মহর্ষি যোগবলে আকাশে উড্ডীয়মান হননি, কিন্তু আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে দ্রুতগতিতে অবতরণ করার সময় ভূপৃষ্ঠ কিরূপ বৃহৎ আকার ধারণ করতে থাকে।
কিন্তু এর উল্টোটা করা কঠিন কঠিন কেন, অসম্ভব। অর্থাৎ দ্রুতগতিতে উপরের দিকে যাচ্ছি আর দেখছি পৃথিবীর তাবৎ বস্তু ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছে–এ জিনিস অসম্ভব, কারণ দৌড় মেরে উপরের দিকে যাওয়া যায় না।
সেটা সম্ভব হয় অ্যারোপ্লেন চড়ে।
মাটির উপর দিয়ে প্লেন চলছিল মারাত্মক বেগে, সেটা ঠাহর হচ্ছিল অ্যারড্রোমের দ্রুত পলায়মান বাড়িঘর, হাঙ্গার, ল্যাম্পপোস্ট থেকে; কিন্তু যেই প্লেন শ-পাঁচেক ফুট উপরে উঠে গেল, তখন মনে হল আর যেন তেমন জোর গতিতে সামনের দিকে যাচ্ছিনে।
উপরের থেকে নিচের দিকে তাকাচ্ছি বলে খাড়া নারকোল গাছ, টেলিগ্রাফের খুঁটি, তিনতলা বাড়ি ছোট তো দেখাচ্ছিলই, কিন্তু সবকিছু যে কতখানি হোট হয়ে গিয়েছে, সেটা মালুম হল পুকুর, ধানক্ষেত আর রেললাইন দেখে। ঠিক পাখির মতো প্লেনও এক-একবার গা-ঝাড়া দিয়ে দিয়ে এক-এক ধাক্কায় উঠে যাচ্ছিল বলে নিচের জিনিস ছোট হয়ে যাচ্ছিল এক-এক ঝটকায়।
জয় মা গঙ্গা! অপরাধ নিও না মা, তোমাকে পবননন্দনপদ্ধতিতে ডিঙিয়ে যাচ্ছি বলে। কিন্তু মা, তুমি যে সত্যি মা, সেটা তো এই আজ বুঝলুম তোমার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময়। তোমার বুকের উপর কৃষ্ণাম্বরী শাড়ি, আর তার উপর শুয়ে আছে অগুনতি ক্ষুদে ক্ষুদে মানওয়ারি জাহাজ, মহাজনি নৌকা– আর পানসিডিঙির তো লেখাজোখা নেই। এতদিন এদের পাড় থেকে অন্য পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি বলে হামেশাই মনে হয়েছে, জাহাজ-নৌকা এরা তেমন কিছু ছোট নয়, আর তুমিও তেমন কিছু বিরাট নও, কিন্তু আজ কী এ দেখি, দেখি, দেখি, আজ কী দেখি? এই যে ছোট ছোট আণ্ডা-বাচ্চারা তোমার বুকের উপর নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছে, তারা তোমার বুকের তুলনায় কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য! এদের মতো হাজার হাজার সন্তান-সন্ততিকে তুমি অনায়াসে তোমার বুকের আঁচলে আশ্রয় দিতে পার।
প্লেন একটুখানি মোড় নিতেই হঠাৎ সর্বব্রহ্মাণ্ডের সূর্যরশ্মি এসে পড়ল মা গঙ্গার উপর। সঙ্গে সঙ্গে যেন এপার ওপার জুড়ে আগুন জ্বলে উঠল, কিন্তু এ আগুন যেন শুভ্র মল্লিকার পাপড়ি দিয়ে ইস্পাত বানিয়ে। সেদিকে চোখ ফিরে তাকাই তার কী সাধ্য মনে হল স্বয়ং সূর্যদেবের রুদ্রের মুখের দিকে তাকাচ্ছি; তিনি যেন শুধু স্বচ্ছ রজত-যবনিকা দিয়ে বদন আচ্ছাদন করে দিয়েছেন। এ কী মহিমা, এ কী দৃশ্য? কিন্তু এ আমি সইব কী করে? তোমার দক্ষিণ মুখ দেখাও, রুদ্র। হে পূষণ, আমি উপনিষদের জ্যোতিষ্টা ঋষি নই, যে বলব,
হে পূষণ, সংহরণ
করিয়াছ তব রশ্মিজাল,
এবার প্রকাশ করো
তোমার কল্যাণতম রূপ,
দেখি তারে যে-পুরুষ
তোমার আমার মাঝে এক।
আমি বলি, তব রশ্মিজাল তুমি সংহরণ কর, তুমি আমাকে দেখা দাও, তোমার মধুর রূপে, তোমার রুদ্র রূপে নয়। তোমার বদন-যবনিকা ঘনতর করে দাও।
তাই হল– হয়তো প্লেন তারই আদেশে পরিপ্রেক্ষিতে বদলিয়েছে– এবার দেখি গঙ্গাবক্ষে স্নিগ্ধ রজত-আচ্ছাদন আর তার উপর লক্ষ কোটি অলস সুরসুন্দরী সব শুধুমাত্র তাদের নূপুর দৃশ্যমান করে নৃত্য আরম্ভ করেছেন। কিন্তু এ নৃত্য দেখবার অধিকার আমার আছে কি? রুদ্র না হয় অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু তার চেলা নন্দীভঙ্গীরা তো রয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাদের সমঝে চলতেন, যদিও ওদিকে পূষণের সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিল তাই বলেছেন,
ভৈরব, সেদিন তব প্রেতসঙ্গীদল রক্ত-আঁখি!
অস্ট্রিচ পাখি যেরকম ভয় পেলে বালুতে মাথা গুঁজে ভাবে, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না, আমিও ঠিক তেমনি পকেট থেকে কালো চশমা বের করে পরলুম– এইবারে নূপুর-নৃত্য দেখতে আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
শুনি, স্যর স্যর! এ কী জ্বালা! চেয়ে দেখি প্লেনের স্টুয়ার্ড ট্রেতে করে সামনে লজেঞ্জুস ধরেছে। বিশ্বাস করবেন না, সত্যি ল্যাবে! লাল, পিলা, ধলা, হরেক রঙের। লোকটা মশকরা করছে নাকি–আমি ছোঁড়ার বাপের বয়সী–আমাকে দেখাচ্ছে লজেন্স! তার পর কি ঝুমঝুমি দিয়ে বলবে, বাপধন এইটে দোলাও দিকিনি, ডাইনে-বায়ে, ডাইনে– আর বায়ে!
এদিকে রসভঙ্গ করল, ওদিকে দেখাচ্ছে লজেজুসের রস। আমি মহা বিরক্তির সঙ্গে বললুম, থ্যাঙ্ক ইউ।
লোকটা আচ্ছা গবেট তো? শুধাল, থ্যাঙ্ক ইউ, ইয়েস; অর থ্যাঙ্ক ইউ, নো। মনে মনে বললুম, তোমার মাথায় গোবর। বাইরে বললুম, নো। কিন্তু এবারে আর থ্যাঙ্ক ইউ বললুম না।
কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, মশাইরা, বেশিরভাগ ধেড়েরাই লজেন্স নিল এবং চুষল।
তবে কি হাওয়ায় চড়ে এদের গলা শুকিয়ে গিয়েছে, আর ওই বাচ্চাদের মাল নিয়ে গলা ভেজাচ্ছে আল্লায় মালুম।
ওমা ততক্ষণে দেখি সামনে আবার গঙ্গা। কাটোয়ার বাঁক।