কলকাতার উর্দুভাষী, তথা বাঙলা এবং উর্দু দোভাষীরা বলেন, হুসন্-ই-হিনা। হুসন শব্দটি আরবি, অর্থ সৌন্দর্য, খুবসুরতি যার থেকে আমাদের মহরমের হাসন হোসেন জিগির শ্লোগান শব্দদ্বয় এসেছে। হিনা শব্দ বাঙলায় হেনা। রবীন্দ্রনাথের গান আছে হেনা, হেনার মঞ্জরি। হেনা শব্দের অর্থ মেহদি। হাসনোহানার পাতা অনেকটা মেহদিপাতার মতো। তা হলে দাঁড়াল এই– হেনার সৌন্দর্য। অর্থাৎ সুন্দরতম হেনা। অর্থাৎ হেনা par excellence। কিন্তু জিনিসটা তো আর হেনা নয়।
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু বিহার, উত্তরপ্রদেশ লক্ষ্ণৌ-দিল্লি, আজমির-বরদা সর্বত্রই এ ফুলটি ডাকা হয় রাতকি রানি নাম ধরে। গুজরাতে অবশ্য রাত-নি রানি ধরে। অর্থ, রাতের রানি। হস-ই-হিনা সমাস এরা চেনেন না। দিল্লিতে আপনি হাসনোহনার আতর কিনতে পাবেন। কিন্তু চাইবার সময় বলতে হবে, রাতকি রানির আতর। হাসনোহনা বা হুস-ই-হিনা বললে চলবে না। খাস হেনার আতর আলাদা।
কাবুল কান্দাহার ব্রিজ তেহরানে এ ফুল নেই। ত্রিশ বছর পূর্বে ছিল না একথা আমি বুক ঠুকে বলতে পারি। হেনা অর্থাৎ মেহদিপাতা অবশ্য আছে। এই ইরানের কবিরা ভারতের মেহদির প্রচুর গুণ-গান গেয়েছেন। যথা
পরিপূর্ণতা পাবে তুমি কোথা
ইরান দেশের ভূঁয়ে,
মেহদির পাতা কড়া লাল হয়
ভারতের ভূঁই ছুঁয়ে।
নিস্ত দরু ইরান, জমিন সমান-ই
তহসিল-ই কামিল
তা নিয়ামি সেই হিন্দোস্তান
হিনা রঙিন ন শুদ্।(১)
হাসনোহনা গাছ ইরান-তুরানে নেই কিন্তু শব্দটা তো অভিধানে থাকতে পারে যেমন আকাশ কুসুম কিংবা অশ্ব-ডিম্ব ত্রিভুবনে নেই বটে (যদিও তার অনুসন্ধান চলে, যেমন পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শোপেনহাওয়ার দর্শনচর্চার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, অমাবস্যার অন্ধকার অঙ্গনে অন্ধের অনুপস্থিত অসিত অশ্ব অরে অনুসন্ধান) তবু অভিধানে শব্দগুলো পাওয়া যায়। হাতের কাছে রয়েছে স্টাইনগাস্ সাহেবের অত্যুকৃষ্ট –এমনকি সর্বোকৃষ্ট বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না– অভিধান। আর রয়েছে ক্যাথলিক পাদ্রি হাভা সাহেবের আরবি কোষ, বেইরুৎ থেকে প্রকাশিত। এই ফারসি আরবি কোনও কোষেই হুসনু-ই-হিনা নেই। হুসন ও হিনার মাঝখানে যে ই আছে এটি খাঁটি ফারসি। কাজেই এই সমাসটি আরবি অভিধানে থাকার কথা নয়। তবু, যেহেতু আরবরা ইরান বিজয়ের পর বহু ফারসি শব্দ আপন ভাষায় গ্রহণ করে, তাই ভাবলুম, হয়তো শব্দটা থাকতেও পারে। বিশেষ করে ফুলের মামেলা যখন রয়েছে। কারণ ল ফারসিতে ফুল।
আপ (সংস্কৃত অপ) ফারসিতে জল। অর্থাৎ আমরা যাকে বলি গোলাপ ফুল। আসলে কিন্তু গোলাপ (শুলাপ) অর্থ রোজওয়াটার। আরবিতে গ এবং প ধ্বনি নেই বলে গোলাপ হয়ে গেল জুলাব। গোলাপ জল বিরেচক। তাই বাঙলাতে জোলাপ গোলাপ দুটি সমাসই প্রবেশ করেছে।
তা সে যাই হোক, আরবরা যখন গুল নিয়েছে তখন হাসনোহানা নিতে আপত্তি কী?
কিন্তু আরবি অভিধান নীরব। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় উর্দু অভিধানও শব্দটির উল্লেখ করে না। উত্তর প্রদেশের উর্দুভাষীরা হাসনোহানাকে রাতকি রানি বলেন বলুন, কিন্তু কোষকার কলকাতায় প্রচলিত হুসন-ই-হিনা তার অভিধানে দিলে ভালো করতেন।
তাই আমার সমস্যা:
১, হয় শব্দটা জাপানি থেকে এসেছে।
২. নয়, এটি কলকাতার উর্দুভাষীদের নিরবদ্য অবদান।
পাঠক ভাববেন না আমি রাজশেখরের ভুল দেখাবার জন্য এ আলোচনা তুলেছি। রাজশেখর শত ভুল করলেও তার অভিধান চলন্তিকাশতায়ু-সহস্ৰায়ু। চলন্তিকা চলে এবং চলবে।
আমার নিবেদন, বাঙলা দেশে এখন গোটা চারেক বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলোতে বাঙলা ভাষা পুরো সম্মান পাচ্ছে। বাঙলায় আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ নিয়ে পয়লারি গবেষণা হওয়া উচিত।
ইতোমধ্যে কোনও পাঠক-পাঠিকা যদি বিষয়টির উপর আলোকপাত করেন তবে বড় উপকৃত হই।(২)
————
১. উর্দুতে হেনা নিয়ে অজস্র দোহা কবিতা আছে। হেনা বলছে
পিস্ গয়ি তো পিস্ গয়া,
ঘুঁ হো গয়া তো হো গয়া
নাম তো বর্গে হিনাকা।
দুলহিনোঁ মে হো গয়া
‘আমায় পিষে ফেললে তো ফেললে, আমি রক্তাক্ত হয়ে গেলুম তো গেলুম। কিন্তু কনেদের ভিতর তো মেহদি পাতার নাম রাষ্ট্র হল। ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান কনেদের মেহদি দিয়ে হাত রাঙা করতে হয়। আরেক কবি বলেছেন, হেনার পাতার উপর হৃদয়-বেদনা লিখি; হয়তো পাতাটি একদিন প্রিয়ার হাতে পৌঁছবে।‘
হাসনোহানা যখন দেশে বেরোয় তখন এ বিষয়ে দেশ পত্রিকায় একাধিক পত্র আলোচনা বিভাগে প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বাড়ির লোক আমার লেখার কাটিং রাখে, আলোচনার রাখে না। যতদূর মনে পড়ছে, একাধিক লেখক আগ্রাণ চেষ্টা দেন, আমাকে বোঝাবার জন্য; হাসনোহনা ও হেনা ভিন্ন। আমার রচনাটি একটু মন দিয়ে পড়লে আমি যে দুটোতে ঘুলিয়ে ফেলিনি সেটা পরিষ্কার হবে। হেনা-par excelance এস্থলে ওই দুটি ফরাসি শব্দ বোঝায় যে par excellance রূপে যে বস্তু ধারণ করে, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্র ও বর্ণের হতে পারে। একটি মহিলা সুদূর দ্রৈাবাদ থেকে হেনা ও হাসনোহনার পাতা আলাদা করে, নিশ্চয়ই অনেকখানি কষ্ট স্বীকার করে পাঠান। তাকে ধন্যবাদ। দুটি গাছই আমার বাগানে আছে … অন্য একজন লেখেন, সুনীতিবাবু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, হাসনোহনা জাপানি শব্দ। সুনীতিবাবু দৃঢ় না ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিলেন সেটা গুরুত্বব্যঞ্জক নয়, গুরুত্ব ধরত যদি পত্রলেখক সুনীতিবাবুর যুক্তিগুলোর উল্লেখ করতেন। কারণ আমার এক সহকর্মী হিন্দি ও উর্দু বাদে তার আপন কর্মক্ষেত্রে, সুনীতিবাবুরই মতো যশস্বী পণ্ডিত (নাম বলে কাউকে বুলি কার কী দরকার!) দৃঢ়তর কণ্ঠে বলেন, সমাসটা ফারসি এদেশে নির্মিত।… তবে এস্থলে বিশ্বকোষের শ্রীযুত পূর্ণ মুখুয্যে আমাকে সাহায্য করেছেন। তিনি লেখেন যে, যে সময়ে এদেশে হাসনোহনা ফুল বিদেশ থেকে আসে তখন জাপানিরা কলকাতার বাজারে হাসনোহনা নাম দিয়ে একটি সুগন্ধি পদার্থ (সেন্ট) ছাড়ে। তার চিঠির ভাবার্থ এই ছিল। তাই আমার মনে হয়, সেই সেন্টের নাম নিয়ে ওই সময় আগত বিদেশি ফুলকে হাসনোহনা নাম দেওয়া হয়। এটা অসম্ভব নয়। প্রাগুক্ত উর্দু পণ্ডিত সেটা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, তিনি ছেলেবেলা থেকেই হুসন-ই-হিনা শুনেছেন। ওই সেন্ট কলকাতা আগমনের বহু পূর্ব থেকে।
০. অবতরণিকা (বড়বাবু)
প্রিন্স্ দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর; তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋষি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে; পিতার চেয়ে তেইশ বছরের ছোট এবং তার জনের সময় তাঁর মাতার বয়স চৌদ্দ। কনিষ্ঠতম ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ তার চেয়ে একুশ, বাইশ বহুরের ছোট।