এই তার সময়। ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ-উচ্ছ্বাসের দুর্দিনে গড়ার কাজ করা যায় না। সে যেন আতসবাজি। সেটা শেষ হলে যে অন্ধকার সেই অন্ধকার। তার পূর্বেই ওরই ক্ষুদ্র শিখা দিয়ে গ্রামে গ্রামে সহস্র সহস্র প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে হয়।
***
এই তার সময়। রাজদরে ভয় নেই, রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত কারসাজি নেই– শান্ত সমাহিত চিত্তে চিন্তা করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, অর্থ সঞ্চয় করতে হবে কী প্রকারে মাতৃভাষার গৌরব সম্বন্ধে সর্ব কাছাড়বাসীকে পরিপূর্ণ সচেতন করা যায়।
সেই চৈতন্যের উপরই মাতৃভাষার দৃঢ়ভূমি নির্মিত হবে।
তাই যখন আবার বিপদ আসবে তখন উন্মাদের মতো দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করতে হবে না, ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে মাইকে চিৎকার করতে হবে না। গ্রামের লোক নিজের থেকেই সাড়া দেবে। শহরে সীমাবদ্ধ যে কোনও আন্দোলনই সহজে দমন করা যায়। কিন্তু সে যদি গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তবে তাকে দমন করা অসম্ভব।
এই তার সময়। চিন্তা করুন, গ্রামে গ্রামে কী প্রকারে সে চৈতন্য উদ্দীপ্ত করতে পারি।
কিন্তু সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
এ আন্দোলন শান্তিময়, গঠনমূলক। এতে কোনও প্রকারের রাজনৈতিক স্বার্থ নেই। এবং সবচেয়ে শেষের বড় কথা–গঠন-কর্ম অগ্রসর হবে অহমিয়া ভ্রাতা, তথা কাছাড়ের কোনও সম্প্রদায় কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি বৈরীভাব না রেখে।(৩)
————
১. সৈয়দ মরতুজা আলী, A History of jaintia, ও এর লেখা ওই যুগের আসাম ও বাঙলার চার রাজবংশের মধ্যে বাঙলায় লেখা চিঠিপত্র, দলিলদস্তাবেজ সম্বন্ধে একাধিক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
২. আমার অগ্রজ পূর্বোল্লিখিত সৈয়দ মরতুজা আলী আসামে রাজকর্মচারী ছিলেন। তিনি আমাকে ১৯৪১ সালেই(!) বলেন যে, সেনসাস নিয়ে কারসাজি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
৩. অমিতাভ চৌধুরী, মুখের ভাষা বুকের রুধির।
হাসনোহনা
বছর বারো পূর্বে ভারতীয় একখানা জাহাজ সুয়েজের কাছাকাছি লোহিত সাগরে আগুন লেগে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। কাপ্তেন সারেঙ মাঝিমাল্লা বেবাক লোক মারা যায়। আশপাশের জাহাজ মাত্র একটি অর্ধদগ্ধ জীবন্ত খালাসিকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। তাকে সুয়েজ বন্দরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবরের কাগজে মাত্র কয়েক লাইনে সমস্ত বিবরণটা প্রকাশিত হয়, এবং সর্বশেষে লেখা ছিল, সেই অর্ধদগ্ধ খালাসিটি কাতরকণ্ঠে জল চাইছে কিন্তু বার বার জল এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও জল খাচ্ছে না।
অলস কৌতূহলে আমি আর পাঁচজনের মতো খবরটি পড়ি। কিন্তু হঠাৎ মগজের ভিতর ক্লিক্ ক্লিক করে কতকগুলি এলোপাতাড়ি ফেলে-দেওয়া টুকরো টুকরো তথ্য একজোট হয়ে কেমন যেন একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলল।
প্রথমত, সুয়েজ বন্দরের কাছে-পিঠে আমি আমার প্রথম যৌবনের একটি বছর কাটিয়েছিলুম। সেখানে জল-কে মা-ই বলা হয়; যদিও খাঁটি আরবিতে জলকে মা-আ বলা হয়। দ্বিতীয়ত ভারতীয় জাহাজের খালাসি পুব বাঙলার মুসলমান হওয়ারই কথা। এবং পুব বাঙলায়, বিশেষ করে সিলেট মৈমনসিং অঞ্চলে মা-কে মা-ই বলে।
অতএব খুব সম্ভব ওই অর্ধ-দগ্ধ খালাসি বেচারি আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে কাতরকণ্ঠে আপন মাতাকে স্মরণ করে বার বার যে মা-ই মা-ই বলছিল তখন সে সুয়েজের আরবিতে জল চাইছিল না। তাই জল দেওয়া সত্ত্বেও সে সে-জল প্রত্যাখ্যান করছিল।
অর্থাৎ একই শব্দ একই ধ্বনি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ধরতে পারে।
তাই একটি শব্দ নিয়ে আমি হালে অনেক চিন্তা করেছি।
হাসুনোহানা। রাজশেখরবাবু এইভাবেই বানান করেছেন। কিন্তু বানান নিয়ে আমার মাথাব্যথা নয়। শিরঃপীড়া শিকড়ে। অর্থাৎ শব্দটার রূট কী? ব্যুৎপত্তি কী?
রাজশেখর বলছেন, জিাপানি।=পদ্মফুল) সাদা সুগন্ধ ছোট ফুল বিঃ (অশুদ্ধ কিন্তু সুপ্রচলিত)।
সুবল মিত্র বলছেন, জাপানি। একরকম ছোট সুগন্ধি ফুল।
বাঙলায় আর যে দু-খানা উত্তম অভিধান আছে তার প্রথম, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ এবং দ্বিতীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙলা ভাষার অভিধান। উভয় অভিধানেই শব্দটি নেই। এটা কিছু বিচিত্র নয়। পঞ্চাশ-ষাট বছর মাত্র হল শব্দটা লেখাতে ঢুকেছে- আমার যতদূর জানা।
শুনেছি, বাঙলা থেকে সংস্কৃতাগত শব্দ বাদ দিলে শতকরা ষাটটি শব্দ আরবি ফারসি কিংবা তুর্কি। ডজন দুত্তিন পর্তুগিজ এবং শ-কয়েক ইংরেজি। ফরাসি ইত্যাদি নগণ্য। জাপানি আর কোনও শব্দ বাঙলাতে আছে বলে জানিনে। আমরা শান্তিনিকেতনের লোক কিমোনো— জাপানি আলখাল্লা শব্দটা ব্যবহার করি, কিন্তু সেটি কোনও অভিধানে ঢুকেছে বলে জানিনে, সাহিত্যে তো নয়ই। কিমোনো পরিহিত সত্যপ্রকাশ ও রবীন্দ্রনাথের ছবি রবীন্দ্ররচনাবলীতে পাওয়া যায়।
তাই প্রশ্ন, হঠাৎ দুম্ করে একটা জাপানি শব্দ বাঙলায় ঢুকল কী করে? তবে কি জাপান থেকে এসেছে হাসনোহানা ফুল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা চিত্রকর বিনোদ মুখুজ্যে, নন্দলালের নন্দন বিশ্বরূপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জাপান দেখে এসেছেন। অন্ধ্রের বীরভদ্র রাও, মালাবারের হরিহরণ। এরা সবাই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র। তাই এদের চিনি। এঁরা সবাই অজ্ঞতাবে মাথা নেড়ে বলেন হাসনোহনা ফুল জাপানে নেই- অর্থাৎ আমরা এদেশে যেটাকে হাসনোহনা বলে চিনি এবং শব্দটার ব্যুৎপত্তি জাপানি এ সম্বন্ধে সকলেই গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেন। তার অন্যতম কারণ এরা সকলেই বাঙলা জানেন– বীরভদ্র হরিহরণ শান্তিনিকেতনে নন্দলালের সাহচর্যে অত্যুত্তম বাঙলা শিখেছেন এবং জাপানি আর কোনও শব্দ হুট করে বাঙলায় ঢুকে গিয়ে থাকলে তারা এ প্রসঙ্গে নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।