দম নেবার জন্য তাকে থামতে হল। হঠাৎ কুকুরগুলোর চিৎকার থেমে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডের হৃদস্পন্দনও যেন থেমে গেল। তা হলে তারা নিশ্চয়ই ছোরা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে।
রেনসফর্ড উত্তেজনার চোটে চড়চড় করে একটা গাছে উঠে পিছনপানে তাকাল। তার তাড়নাকারীরা তখন দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু গাছে চড়ার সময় রেনসফর্ড তার হৃদয়ে যে আশা পুষেছিল সেটা লোপ পেল; সে দেখতে পেল শুকনো উপত্যকার উপর জেনারেল জারফ আপন পায়ের উপরই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ইভান নয়। জ্যা-মুক্ত চারাগাছের আঘাতে ছোরাটা সম্পূর্ণ নিষ্ফলকাম হয়নি।
রেনসফর্ড হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়তে না পড়তে কুকুরগুলো আবার চিৎকার করে উঠল।
আবার দৌড়তে আরম্ভ করে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলছে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, হবে, হবে। একদম সামনে, গাছগুলোর ফাঁকে দেখা দিয়েছে এক ফালি নীলরঙের ফাঁকা! রেনসফর্ড প্রাণপণ ছুটল সেদিক পানে। পৌঁছল সেখানে। সেটা সমুদ্রের পাড়। সমুদ্র সেখানে খানিকটে ঢুকে গিয়ে ছোট্ট উপসাগরের মতো আকার ধরেছে। রেনসফর্ড তারই ওপারে দেখতে পেল বিষণ্ণ পাওটে পাথরের তৈরি জেনারেলের শাটো। রেনসফর্ডের পায়ের বিশ ফুট নিচে সদ্ৰ গজরাচ্ছে আর ফোঁস ফোঁস করছে। রেনসফর্ড দোটানায়। শুনতে পেল কুকুরগুলোর চিৎকার। লাফ দিয়ে পড়ল দূরে, সমুদ্রে।
জেনারেল আর তার কুকুরের পাল সে জায়গায় পৌঁছলে পর তিনি সেখানে থামলেন। কয়েক মিনিটের তরে তাকিয়ে রইলেন নীলসবুজ বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে। ঘাড়ের ঝাঁকুনি দিয়ে যাকগে ভাব প্রকাশ করলেন। তার পর মাটিতে বসে কুপোর ফ্লাস্ক থেকে ব্রান্ডি খেয়ে সুগন্ধি সিগারেট ধরিয়ে মাদাম বাটারফ্লাই গীতিনাট্য থেকে খানিকটা গান গুনগুন করে গাইলেন।
সে রাত্রে তার কাঠের আস্তরওলা বিরাট ডাইনিং হলে জেনারেল জারফ অত্যুকৃষ্ট ডিনার খেলেন। সঙ্গে পান করলেন এক বোতল পল রজের আর আধ বোতল শ্যাবেরতা। দুটি যৎসামান্য বিক্তিকর ঘটনা তাকে পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগে বাধা দিল মাত্র। তার একটা, ইভানের স্থলে অন্য লোক পাওয়া কঠিন হবে এবং অন্যটা, তার শিকার হাতছাড়া হয়ে গেল বলে-স্পষ্টই দেখা গেল যে মার্কিনটা আইনমাফিক শিকারের খেলাটা খেলল না। ডিনারের পর লিক্যোয়ে চুমুক দিতে দিতে অন্তত জেনারেলের তাই মনে হল। আরাম পাবার জন্য তাই তিনি তার লাইব্রেরিতে মার্কস আউরেলিয়ুসের রচনা পড়লেন। দশটার সময় তিনি শোবার ঘরে ঢুকলেন। দোরে চাবি দিতে দিতে তিনি আপন মনে বললেন, আজকের ক্লান্তিটা তার বড় আরামের ক্লান্তি। সামান্য একটু চাঁদের আলো আসছিল বলে তিনি বাতি সুইচ করার পূর্বে জানালার কাছে গিয়ে নিচে আঙিনার দিকে তাকালেন। বিরাট কুত্তাগুলোকে দেখে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আসছে বারে তোমাদের কপাল ভালো হবে, আশা করছি। তার পর তিনি আলো সুইচ করলেন।
খাটের পর্দার আড়ালে যে লোকটা লুকিয়ে ছিল সে সেখানে দাঁড়িয়ে।
জেনারেল চেঁচিয়ে বললেন, রেনসফর্ড! ভগবানের দোহাই, তুমি এখানে এলে কী করে?
রেনসফর্ড বলল, সতরে। আমি দেখলুম, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে না এসে এভাবেই তাড়াতাড়ি হয়।
জেনারেল ঢোক গিললেন, তার পর মৃদু হেসে বললেন, আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনি শিকারে জিতেছেন!
রেনসফর্ড স্মিতহাস্য হাসল না। নিচুস্বরে হিসহিসিয়ে সে বলল, আমি এখনও কোণঠাসা শিকারের পশু। তৈরি হোন, জেনারেল জার!
জেনারেল যেভাবে নিচু হয়ে বাও করলেন সেটা তাঁর গভীরতম বাওয়ের একটি। বললেন, তাই নাকি? চমৎকার! আমাদের একজনকে কুত্তাগুলোর খানা হতে হবে। অন্যজন ঘুমুবে এই অতি উৎকৃষ্ট শয্যায়। এসো রেনসফর্ড, হুশিয়ার…
রেনসফর্ড সিদ্ধান্ত করল, এরচেয়ে ভালো বিছানায় সে কখনও ঘুমোয়নি।
[বিদেশি গল্পের অনুবাদ।]
হতভাগ্য কাছাড়
প্রশ্ন উঠতে পারে, কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন যখন তার চরমে তখন সম্পূর্ণ নীরব থেকে আজ এতদিন পরে সেই পুরনো কাহিনী নিয়ে পড়ি কেন? কাছাড়িতেও আছে,
স্বামী মরল সন্ধ্যা রাত!
কেঁদে উঠল দুপুর রাত!!
(খাস কাছাড়িতে লিখলে পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে বলে সংস্কৃত করা হল।)
আসলে তখন ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক রেষারেষি তিক্ততায় রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি কোনও কোনও স্থলে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। অথচ কাছাড়ে কস্মিনকালেও কোনপ্রকারের সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। হিন্দু, মুসলমান, মণিপুরি (তাদের ভিতরেও হিন্দু-মুসলমান দুই-ই আছে), নাগা, লুসাই এবং আরও কত যে জাত-বেজাত কাছাড়ে সখ্যভাবে বসবাস করে সে সম্প্রীতি না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
তখন আমার জানা ছিল, এ আন্দোলন বেশিদিন চলবে না, একটা রফারফি হয়ে যাবেই, এবং তার পর কাছাড়বাসীরা ভাষার কথা বেবাক ভুলে গিয়ে আবার সুখ-নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বে। পারি যদি তখন তাকে জাগাবার চেষ্টা করব। সর্বত্রই দেখেছি, পাকা বনিয়াদ গঠনের কাজ আরম্ভ হয় তখনই।
***
কাছাড়ের উত্তর, পুব, দক্ষিণে পাহাড়। তার বেরোবার পথ মাত্র পশ্চিম দিকে পুব পাকিস্তানের সিলেটের ভিতর দিয়ে। সে পথ আজ বন্ধ। হিল সেকশন নামক যে রেলপথটি কাছাড়কে ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে সেটি নির্মিত হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা চট্টগ্রাম বন্দর তথা চাঁদপুর হয়ে কলিকাতার বন্দরে পাঠাবার জন্য। ওটা কখনও কাছাড়িদের বিশেষ কোনও কাজে লাগেনি।