জেনারেল যখন তাঁর ছড়ে যাওয়া ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেলেন তখন রেনসফর্ড আবার আরম্ভ করল তার পলায়ন। এবারে সত্যকার পলায়ন– আশাহীন, জীবনমরণের পলায়ন, এবং সে পলায়ন চলল কয়েক ঘণ্টা ধরে। গোধূলির আলো নেমে এল, তার পর অন্ধকার হল, তবু তার অগ্রগতি বন্ধ হল না। পায়ের নিচের মাটি তখন নরম হতে আরম্ভ করেছে, গুলতা ঘনতর নিবিড়তর হতে লাগল, পোকাগুলোও ভীষণভাবে তাকে কামড়াতে আরম্ভ করেছে। তার পর আরেকটু এগুতেই তার পা জলা-মাটিতে ঢুকে বসে গেল। সে তার পা-টা মুচড়ে টেনে বের করবার চেষ্টা করল কিন্তু সেই চোরা-কাদা বিরাট জোকের মতো তার পা পাশবিক শক্তির সঙ্গে শুষতে লাগল। প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে রেনসফর্ড তার পা-খানা মুক্ত করল। সে তখন বুঝতে পেরেছে, কোথায় এসে পৌঁছেছে। এ সেই মরণ-জলা তার চোরাবালি নিয়ে।
তার হাত দুটি তখন মুষ্টিবদ্ধ। যেন তার বিচারবুদ্ধির সুস্থ স্নায়ুবল ধরা-ছোঁয়ার জিনিস এবং সেইটাকে অন্ধকারে কে যেন তার কজা থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওই থলথলে মাটি তার মনে এক নতুন কৌশল এনে দিল। চোরাবালি থেকে ডজনখানেক ফুট পিছিয়ে গিয়ে যেন কোনও আদিম অন্ধকার যুগের মৃত্তিকা খননদক্ষ বিরাট বিভারের মতো সে মাটি খুঁড়তে লাগল।
ফ্রান্সে যুদ্ধের সময় মাটি খুঁড়ে রেনসফর্ড ট্রেঞ্চের ভিতর আশ্রয় নিয়েছে তখন এক সেকেন্ডের বিলম্ব হওয়ার অর্থ ছিল মৃত্যু। তখনকার মৃত্তিকাখনন এর তুলনায় তার কাছে গদাইলস্করি চালের খেলাধুলো বলে মনে হল। গর্তটা গম্ভীর হতে গভীরতর হতে লাগল; যখন সেটা তার ঘাড়ের চেয়েও গম্ভীর হল তখন সেটার থেকে বেয়ে উঠে কতকগুলো শক্ত গাছের চারা কেটে ডগাগুলো সূচাগ্র তীক্ষ্ণ করে বানাল বর্শার মতো করে। ডগাগুলো উপরমুখো করে সেগুলো সে পুঁতে দিল গর্তের তলাতে। আগাছা আর ছোট ছোট ডাল নিয়ে দ্রুত হস্তে একটা এবড়ো-খেবড়ো কার্পেটের মতো করে বুনল এবং সেটা গর্তের উপর পেতে মুখটা বন্ধ করে দিল। ঘামে জবজবে ভেজা ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর নিয়ে সে গুঁড়ি মেরে বসল একটা বাজে পোড়া গাছের গুঁড়ির পিছনে।
সে বুঝতে পেরেছে তার তাড়নাকারী আসছে; নরম মাটির উপর পায়ের থপ থপ শব্দ শুনতে পেয়েছে এবং রাত্রের মৃদু বাতাস জেনারেলের সিগারেট-সৌরভ তার কাছে নিয়ে এসেছে। তার মনে হল যেন জেনারেল অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছেন; আগের মতো এক ফুট এক ফুট করে সমঝে-বুঝে আসছেন না। যেখানে শুড়ি মেরে রেনসফর্ড বসে ছিল সেখান থেকে সে জেনারেল বা গর্তটা কোনও কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। প্রত্যেকটি মিনিট যেন তার কাছে এক-একটা বছরের আয়ুষ্কাল বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। তার পর, হঠাৎ সে উল্লাসভরে সানন্দে চিৎকার করতে যাচ্ছিল। কারণ সে শুনতে পেয়েছে মড়মড় করে গর্তের ঢাকনা ভেঙে নিচে পড়ে গিয়েছে; ধারালো কাঠের ডগাতে পড়ে কে যেন বেদনার তীক্ষ্ণ আতাঁর ছেড়েছে। তার লুকানো জায়গা থেকে সে লাফ দিয়ে উঠেছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে যেন মুষড়ে গিয়ে পিছু হটল। গর্ত থেকে তিন ফুট দূরে একজন মানুষ ইলেকট্রিক টর্চ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেনারেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। শাবাস রেনসফর্ড, তোমার বর্মা-পদ্ধতিতে তৈরি গর্তটা আমার সবচেয়ে সেরা কুকুরদের একটাকে গ্রাস করেছে। আবার তুমি জিতলে। এবারে দেখব মিস্টার রেনসফর্ড, তুমি আমার পুরো পাল কুকুরের বিরুদ্ধে কী করতে পার। আমি এখন বাড়ি চললুম একটু বিশ্রাম করতে। ভারি আমোদে কাটল সন্ধ্যাটা তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
জলাভূমির কাছে শুয়ে রাত কাটানোর পর ভোরবেলা তার ঘুম ভাঙল এমন একটা শব্দ শুনে যেটা তাকে বুঝিয়ে দিল যে ভয় বলতে কী বোঝায় সে সম্বন্ধে এখনও তার নতুন কিছু শেখবার আছে। শব্দটা আসছিল দূর থেকে ক্ষীণ, এবং ভাসা ভাসা। একপাল কুকুরের চিৎকার।
রেনসফর্ড জানত, সে দুটোর একটা করতে পারে। যেখানে আছে সেখানেই থেকে অপেক্ষা করা। সেটা আত্মহত্যার শামিল। কিংবা সে ছুট লাগাতে পারে। সেটা হবে অবধারিতকে মুলতবি করা। এক মুহূর্তের তরে সে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। তার মাথায় যা এল সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা অতিশয় ক্ষীণ। কোমরের বেল্ট শক্ত করে নিয়ে সে জলাভূমি ত্যাগ করল।
কুকুরগুলোর চিৎকার আরও কাছে আসছে, তার পর আরও কাছে, তারচেয়ে আরও কাছে। পাহাড়ের খাড়াইয়ের উপরে একটা গাছে চড়ে রেনসফর্ড দেখতে পেল, একটি জলধারার পোয়াটাক মাইল দূরে একটা ঝোঁপ নড়ছে। চোখ যতদূর সম্ভব পারে টাটিয়ে দেখতে পেল জেনারেলের একহারা শরীর আর তার সামনে আরেকজনের বিশাল স্কন্ধ জঙ্গলের উঁচু বোনো ঘাস ঠেলে ঠেলে এগুচ্ছে। এ সেই নরদানব ইভান। তাকে যেন কোন অদৃশ্য শক্তি টেনে টেনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে; রেনসফর্ডের বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না সে কুকুরগুলোর চেন হাতে ধরে রেখেছে।
যে কোনও মুহূর্তে তারা তার ঘাড়ে এসে পড়বে। তার মগজ তখন ক্ষিপ্তবেগে চিন্তা করছে। ইউগান্ডায় শেখা গ্রামবাসীদের একটা ফন্দি তার মনে এল। গাছ থেকে নেমে সে একটা লিকলিকে চারাগাছের সঙ্গে তার শিকারের ছোরাটার ডগা নিচের দিকে মুখ করে বাঁধল সে যে-পথ দিয়ে এসেছে তার ঠিক উপরে; সর্বশেষে চারাগাছটাকে লতা দিয়ে ধনুর মতো বাঁকিয়ে পিছন দিকে বাঁধল। তার পর সে দিল প্রাণপণ ছুট। কুকুরগুলো ইতোমধ্যে আবার তার গন্ধ পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে তীব্রতর স্বরে। এইবারে রেনসফর্ড হৃদয়ঙ্গম করল, কোণঠাসা শিকারের বুকে কোন অনুভূতি জাগে।