রেনসফর্ড বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই।
জেনারেল স্মিতহাস্য করলেন। আমার কিন্তু ভেঙে পড়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। আমাকে তা হলে কিছু একটা করতে হয়। দেখুন, আমার হল গিয়ে বিশ্লেষণকারী মন, মিস্টার রেনসফর্ড। নিঃসন্দেহ সেই কারণেই আমি শিকারের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যায় এত আনন্দ পাই।
রেনসফর্ড বলল, এতে কোনও সন্দেহই নেই, জেনারেল জারক।
তাই আমি নিজেকে শুধালুম, শিকার আমাকে এখন সম্মোহিত করে না কেন? আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট, মিস্টার রেনসফর্ড, এবং আমি যতখানি শিকার করেছি আপনি ততখানি করেননি কিন্তু তবু আপনি হয়তো উত্তরটা অনুমান করতে পারবেন।
সেটা কী?
সোজাসুজি এই; শিকার তখন আমার কাছে আর হয় হারি নয় জিতি ধরনের বিষয় নয়। আমি প্রতিবারেই আমার শিকারকে খতম করছি। সবসময়। প্রতিবারেই। সমস্ত ব্যাপারটা তখন আমার কাছে অত্যন্ত সরল হয়ে গিয়েছে। আর পরিপূর্ণতার মতো একঘেয়েমি আর কিছুতেই নেই।
জেনারেল আরেকটা সিগারেট ধরালেন।
কোনও শিকারেরই আর তখন আমাকে এড়াতে পারবার সৌভাগ্য হতো না। আমি দেমাক করছি না। এ যেন একেবারে অঙ্কশাস্ত্রের নিশ্চয়তা। পশুটার কী আছে– তার পা আর সহজাত প্রবৃত্তি। অন্ধ প্রবৃত্তি তো বুদ্ধির সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারে না। এ চিন্তা যখন আমার মনে উদয় হল সে সময়টা আমার পক্ষে বিষাদময়, আপনাকে সত্যি বলছি।
রেনসফর্ড টেবিলের উপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গোগ্রাসে তার কথা গিলছে।
জেনারেল বলে যেতে লাগলেন, আমাকে কী করতে হবে, সেটা যেন একটা অনুপ্রেরণার মতো আমার কাছে এল।
এবং সেটা কী?
জেনারেল আত্মপ্রসাদের স্মিত হাস্য করলেন। মানুষ কোনও প্রতিবন্ধকের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সেটাকে অতিক্রম করতে পারলে যে মৃদু হাসি হাসে। বললেন, শিকার করার জন্য আমাকে নতুন পশু আবিষ্কার করতে হল।
নতুন পশু? আপনি ঠাট্টা করছেন।
জেনারেল বললেন, মোটেই না। আমি শিকারের ব্যাপার নিয়ে কখনও মশকরা করিনে। আমার প্রয়োজন ছিল একটা নতুন পশুর। পেলুমও একটা। তাই আমি এই দ্বীপটা কিনলুম, বাড়িটা তৈরি করলুম এবং এখানে আমি আমার শিকার করি। আমার কাজের জন্য এই দ্বীপটি একেবারে সর্বাঙ্গসুন্দর- জঙ্গল আছে, তার ভিতর পায়ে চলা-ফেরার রীতিমতো গোলকধাঁধা রয়েছে, পাহাড় আছে, জলাভূমি–
কিন্তু সেই পশুটা, জেনারেল জারফ?
জেনারেল বললেন, ও! এই দ্বীপ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাদায়ক শিকার করতে দিয়েছে। অন্য যে কোনও শিকারের সঙ্গে এর তুলনা এক লহমার তরেও হয় না। আমি প্রতিদিন শিকার করি এবং একঘেয়েমি আমার কাছেই আসতে পারে না কারণ আমার শিকার এমনই ধরনের যে তার সঙ্গে আমার বুদ্ধির লড়াই চালাতে পারি।
রেনসফর্ডের মুখে হতভম্ব ভাব।
আমি চেয়েছিলুম শিকারের জন্য একটা আদর্শ পশু। তাই আমি নিজেকে শুধালুম, আদর্শ শিকারের কোন কোন গুণ থাকে? তার উত্তর স্বভাবতই; তার সাহস, চাতুর্য, এবং সর্বোপরি সে যেন বিচারশক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
রেনসফর্ড আপত্তি জানাল, কিন্তু কোনও পশুরই তো বিচারশক্তি নেই।
জেনারেল বললেন, মাই ডিয়ার দোস্ত, একটা পশুর আছে।
কিন্তু আপনি তো সত্যই সেটা বলতে রেনসফর্ডের দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
না কেন?
আমি বিশ্বাস করতে পারিনে যে আপনি যথার্থ কথা বলছেন, জেনারেল জারফ। একটা বীভৎস রসিকতা।
আমি যথার্থ কথা বলব না কেন? আমি শিকারের কথা বলছি।
শিকার? ভগবান সাক্ষী, আপনি যা বলছেন সে তো খুন!
জেনারেল পরিপূর্ণ খুশ মেজাজে হেসে উঠলেন। রেনসফর্ডের দিকে তিনি মজার সঙ্গে তাকালেন। বললেন, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না যে আপনার মতো সভ্য ও আধুনিক যুবা– আপনাকে দেখলে সেই তো মনে হয় মানুষের প্রাণ সম্বন্ধে রোমান্টিক ধারণা পোষণ করবে। নিশ্চয়ই যুদ্ধে আপনার অভিজ্ঞতা
রেনসফর্ড কঠিন কণ্ঠে বলল, নৃশংস খুন ক্ষমা করতে দেয় না।
উচ্চহাস্যে জেনারেল দুলতে লাগলেন। বললেন, কী অসাধারণ মজার মানুষ আপনি! আজকের দিনে শিক্ষিত সম্প্রদায়ে–এমনকি আমেরিকাতেও এ ধরনের হাবাগোবা সরলবিশ্বাসী– আর যদি অনুমতি দেন তবে বলি– মধ্য ভিক্টোরীয় ধারণার মানুষ পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, তবে কি না, কোনও সন্দেহ নেই আপনার পূর্বপুরুষ গোঁড়া শুদ্ধাচারী (রিটান) ছিলেন। কত না আমেরিকাবাসীর পিতৃপুরুষ এই সম্প্রদায়ের। আমি বাজি ধরছি, আমার সঙ্গে শিকারে বেরুলে এসব ধারণা আপনি ভুলে যাবেন। আপনার অদৃষ্টে খাঁটি নতুন রোমাঞ্চকর উত্তেজনা সঞ্চিত রয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ। আমি শিকারি; খুনি নই।
বিচলিত না হয়ে জেনারেল বললেন, হায়, আবার সেই অপ্রিয় শব্দ! কিন্তু আমার বিশ্বাস আমি আপনার কাছে প্রমাণ করতে পারব, আপনার নৈতিক দ্বিধা ভিত্তিহীন।
সত্যি?
জীবন জিনিসটাই শক্তিমানের জন্য, বেঁচে থাকবে শক্তিমান, এবং প্রয়োজন হলে সে জীবন নিতেও পারে। দুর্বলদের এই পৃথিবীতে রাখা হয়েছে শক্তিমানকে আনন্দ দেবার জন্য। আমি শক্তিমান। আমি আমার বিধিদত্ত উপহার কাজে খাটাব না কেন? আমি যদি শিকার করতে চাই তবে করব না কেন? তাই আমি দুনিয়ার যত আবর্জনাকে শিকার করি– রদ্দি জাহাজের খালাসি, মাঝিমাল্লা, কৃষ্ণাঙ্গ, চীনা, শ্বেতাঙ্গ, দুআঁসলা– একটি অবিমিশ্র রক্তের ঘোড়া বা কুকুর এদের কুড়িটার চেয়ে মূল্যবান।