দিল্লি থেকে কলকাতা আসবার সময় একবার দেখেছিলুম, যে যাত্রী প্লেনের দোলাতে কাতর হয়নি সে এই বাসের ঝাঁকুনিতে বমি করেছিল।
দমদমা পৌঁছলেন। এবার প্লেন না-ছাড়া পর্যন্ত একটানা প্রতীক্ষা। সে-ও প্রায় তিন কোয়ার্টারের ধাক্কা।
তবে সমস্তটা অত মন্দ কাটবে না। জায়গাটা সাফ-সুতরো, বইয়ের স্টল আছে, দমদম আন্তর্জাতিক অ্যার-পোর্ট বলে জাত-বেজাতের লোক ঘোরাঘুরি করছে, ফুটফুটে ফরাসি মেম থেকে কালো-বোরকায় সর্বাঙ্গ ঢাকা পর্দানশিনী হজযাত্রিণী সবকিছুই চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবে :
তবে একথাও ঠিক হাওড়ার প্ল্যাটফর্মের তুলনায় এখানে উত্তেজনা এবং চাঞ্চল্য কম। প্লেনে যখন মাল আর আপনার জায়গা হবেই তখন আর হুতোহুতি গুতোগুতি করার কী প্রয়োজন?
তবু ভারতবর্ষ তাজ্জব দেশ। দিনকয়েক পূর্বে দমদম অ্যার-পোর্ট রেস্তোরাঁয় ভুকে এক গেলাম জল চাইলুম। দেখি জলের রঙ ফিকে হলদে। শুধালুম, শরবত কি ফ্রি বিলোনো হচ্ছে? বয় বলল, জলের টাকি সাফ করা হয়েছে তাই জল ঘোলা এবং মৃদুস্বরে উপদেশ দিল ও-জল না-খাওয়াই ভালো।
শুনেছি, ইয়োরাপের কোনও কোনও দেশে নরনারী এমনকি বাচ্চা-কাচ্চারাও নাকি জল খায় না। দমদমাতে যদি কিছুদিন ধরে নিতি নিত্যি টাকি সাফ করা হয় তবে আমরা সবাই সায়েব হয়ে যাব। শুধু কি তাই, জলের জন্য উদ্বাস্তুরা উদ্ব্যস্ত করে তুলবে না কলকাতা কর্পোরেশনকে। আমরা সবাই তখন রুটির বদলে কেক খাব। সেকথা থাক।
কিন্তু দমদম অ্যার-পোর্টের সত্যিকার জৌলুস খোলে যেদিন ভোরে কুয়াশা জমে। কাণ্ডটা আমি এই শীতেই দু-বার দেখেছি।
ভোর থেকে যেসব প্লেনের দমদম ছাড়ার কথা ছিল তার একটাও ছাড়তে পারেনি। তার প্যাসেঞ্জার সব বসে আছে আর-পোর্টে। আরও যাত্রী আসছে দলে দলে, তাদেরও প্লেন ছাড়তে পারছে না। করে করে প্রায় দশটা বেজে গেল। একদিক থেকে যাত্রীরা চলে যাচ্ছে, অন্যদিক থেকে আসছে, এই স্রোত বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তখন দমদমাতে যে যাত্রীর বন্যা জাগে, তাদের উৎকণ্ঠা, আহারাদির সন্ধান, খবরের জন্য অ্যার কোম্পানির কর্মচারীদের বার বার একই প্রশ্ন শোধানো, ড্যাম ক্যালকাটা ওয়েদার ইত্যাদি কটুবাক্য, নানারকমের গুজব– কোথায় নাকি কোন প্লেন ক্রাশ করেছে, কেউ জানে না যেসব বন্ধুরা সি অফ করতে এসেছিলেন তাদের আপিসের সময় হয়ে গেল অথচ চলে গেলে খারাপ দেখাবে বলে কষ্টে আত্মসম্বরণ, প্লেন টেক অফ করতে পারছে না ওদিকে ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে গিয়েছে বলে যাত্রীদের ফ্রি খাওয়ানো হচ্ছে, কঞ্জুস কোম্পানিগুলো গড়িমসি করছে বলে তাদের যাত্রীদের অভিসম্পাত আরও কত কী?
লাউড স্পিকার ভোর ছটা থেকে রা কাড়েনি। খবর দেবেই-বা কী?
দমদমা নর্থ-পোল হলে কী হত জানিনে শেষটায় কুয়াশা কাটল। হঠাৎ শুনি লাউড কিারটা কুয়াশায়-জমা গলায় কাশি বার কয়েক সাফ করে জানাল, অমুক জায়গার প্যাসেঞ্জাররা অমুক প্লেনে (ডিবিজি, হিবিজি, হিজিবিজি কী নম্বর বলল বোঝা গেল না) করে রওনা দিন।
আমি না হয় ইংরেজি বুঝিনে, আমার কথা বাদ দিন, কিন্তু লক্ষ করলুম, আরও অনেকে বুঝতে পারেননি। গোবেচারিরা ফ্যাল ফ্যাল করে ডাইনে-বায়ে তাকাল, অপেক্ষাকৃত চালাকেরা অ্যার আফিসে খবর নিল, শেষটায় যে প্লেন ছাড়বে তার কোম্পানির লোক আমাদের ডেকে-ডুকে জড় করে প্লেনের দিকে রওনা করে দিল– পাণ্ডারা যেরকম গাইয়া তীর্থযাত্রীদের ধাক্কাধাক্তি দিয়ে ঠিক গাড়িতে তুলে দেয়।
আমার সঙ্গে পাশাপাশি হয়ে যাচ্ছিলেন এক মারোয়াড়ি ভদ্রলোক। আমাকে বললেন, আজকাল তো অনেক ইংরেজি না-জাননেওয়ালা যাত্রী-ভি প্লেন চড়ছে–ত বাঙালি জবান মে প্লেনকা খবর বলে না কাহে?
ওই বুঝলেই তো পাগল সারে।
.
০৩.
দেবরাজকে সাহায্য করে রাজা দুষ্মন্ত যখন পুষ্পক রথে চড়ে পৃথিবীতে ফিরছিলেন, তখন যেমন যেমন তিনি পৃথিবীর নিকটবর্তী হতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়-পর্বত, গৃহ-অট্টালিকা অতিশয় দ্রুতগতিতে তার চক্ষের সম্মুখে বৃহৎ আকার ধারণ করতে লাগল। যতদূর মনে পড়ছে, রাজা দুষ্মন্ত তখন তাই নিয়ে রথীর কাছে আপন বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
পুণার জনৈক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তারই উল্লেখ করে আমার কাছে সপ্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন যে, দুষ্মন্তের যুগ পর্যন্ত ভারতীয়েরা নিশ্চয়ই খপোত নির্মাণ করতে পারতেন, না হলে রাজা ক্রমান্ন পৃথিবীর এহেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন কী প্রকারে?
তার বহু বৎসর পরে একদা রমন মহর্ষি কোনও একটা ঘটনা বিশদভাবে পরিস্ফুট করার জন্য তুলনা দিয়ে বলেন, উপরের থেকে নিচের দিকে দ্রুতগতিতে আসার সময় পৃথিবীর ছোট ছোট জিনিস যেরকম হঠাৎ বৃহৎ অবয়ব নিতে আরম্ভ করে, ঠিক সেইরকম ইত্যাদি ইত্যাদি।
মহর্ষির এক প্রাচীন ভক্ত আমার কাছে বসে ছিলেন। আমাকে কানে কানে বললেন, এখন তো তোমার বিশ্বাস হল যে, মহর্ষি যোগবলে উড্ডীয়মান হতে পারেন। আমাকে একথাটি তার বিশেষভাবে বলার কারণ এই যে, আমি একদিন অলৌকিক ঘটনার আলোচনা প্রসঙ্গে একটি ফারসি প্রবাদবাক্যের উল্লেখ করে বলেছিলুম
পিরহা নমিপরন্দ,
শাগিরদার উন্থারা মিপরানন্দ।
অর্থাৎ পির (মুরশাদ) ওড়েন না, তাদের চেলারা ওঁদের ওড়ান (cause them fly)।
তার কিছুদিন পরে আমি রমন মহর্ষির পীঠস্থল তীরু-আন্নামলাই (শ্রীআন্নামলাই) গ্রামের নিকটবর্তী অরুণাচল পর্বত আরোহণ করি। মহর্ষি এই পর্বতে প্রায় চল্লিশ বৎসর নির্জনে সাধনা করার পর তীব্রু-আন্নামলাই গ্রামে অবতরণ করেন সাধনার ভাষায় অবতীর্ণ হন।