জেনারেল যেন প্রস্তাব করলেন, একটা ককটেল খাবেন তো, মিস্টার রেনসফর্ড ককটেলটি আশ্চর্য রকমের ভালো এবং রেনসফর্ড আরও লক্ষ করল যে, টেবিলের সাজসরঞ্জামও সর্বোত্তম পর্যায়ের টেবিলক্লথ, ন্যাপকিন, স্ফটিকের পাত্রাদি, রুপো এবং চীনেমাটির বাসনকোসন– সবকিছুই।
তারা ঘন মশলাওলা সরে মাখানো বৰ্শ সুপ খাচ্ছিলেন। এ সুপটি রাশানদের বড় প্রিয়। যেন আধো মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে জেনারেল জারফ বললেন, সত্যতা যেসব সুখ-সুবিধা দেয় আমরা এখানে সেগুলো রক্ষা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা দিই। ত্রুটিবিচ্যুতি হলে মাফ করবেন। জনগণের গমনাগমনের বাঁধা রাস্তা থেকে আমরা যথেষ্ট দূরে– বুঝলেন তো? আপনার কি মনে হয় অনেক দূরের সমুদ্রপথ পেরিয়ে এসেছে বলে শ্যাম্পেনের স্বাদ খারাপ হয়ে গিয়েছে?
রেনসফর্ড বলল, একদম না। তার মনে হয় জেনারেলটি অতিশয় অমায়িক ও যত্নশীল অতিথিসেবক- সত্যিকার বিশ্বনাগরিক। শুধু জেনারেলের একটি ক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্য রেন্সফর্ডের মনে অস্বস্তির সঞ্চার করছিল। যখনই প্লেট থেকে মুখ তুলে সে তার দিকে তাকিয়েছে তখনই দেখেছে তিনি যেন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, সূক্ষ্মতমভাবে যাচাই করে নিচ্ছেন।
জেনারেল জারফ বললেন, আপনি হয়তো আশ্চর্য হয়েছেন আমি আপনার নাম চিনলুম কী করে। বুঝেছেন কি না, ইংরেজি, ফরাসি এবং জর্মন ভাষায় যেসব শিকারের বই বেরোয় আমি তার সব কটাই পড়ি। আমার জীবনের ব্যসন মাত্র একটি, মিস্টার রেনসফর্ড–শিকার।
সুপক্ক ফিলে মিনো খেতে খেতে রেনসফর্ড বলল, আপনার শিকারের মাথাগুলো চমৎকার। ওই যে কেপ মহিষের মাথা এত বড় মাথা আমি কখনও দেখিনি।
ও! ওই ব্যাটা! পুরোদস্তুর দান ছিল সে।
আপনার দিকে তেড়ে এসেছিল নাকি?
একটা গাছের উপর আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আমার খুলিতে ফ্রাকচার হয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমি ব্যাটাকে ঘায়েল করি।
রেনসফর্ড বলল, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে যে বড় শিকারের ভিতর কেপের মোষই সবচেয়ে বিপজ্জনক শিকার।
এক লহমার তরে জেনারেল কোনও উত্তর দিলেন না– তাঁর লাল ঠোঁট দিয়ে তিনি সেই বিচিত্র স্মিত হাস্য হেসে যেতে লাগলেন। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, না, আপনি ভুল করেছেন, স্যর! কেপ মহিষ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক শিকার নয়। তিনি মদের গেলাসে · একটি ছোট্ট চুমুক দিলেন, এই দ্বীপে আমার খাস মৃগয়া ভূমিতে আমি তারচেয়েও বিপজ্জনক শিকার করে থাকি।
রেনসফর্ড বিস্ময় প্রকাশ করে শুধোল, এই দ্বীপে বড় শিকার আছে নাকি?
জেনারেল মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, সবচেয়ে বড়।
সত্যি?
ও! প্রকৃতিদত্ত নয়– নিশ্চয়ই। আমাকে স্টক করতে হয়।
আপনি কী আমদানি করেছেন, জেনারেল? বাঘ?
জেনারেল স্মিত হাস্য করে বললেন, না। বাঘ শিকারে আমার আর কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই– কয়েক বছর হয়ে গেল। বাঘের মুরোদ কতখানি তার শেষ পর্যন্ত আমার দেখা হয়ে গিয়েছে। বাঘ আর আমাকে উত্তেজনা দিতে পারে না কোনও সত্যকার বিপদে ফেলতে পারে না। আমি জীবন ধারণ করি বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য, মিস্টার রেনসফর্ড।
জেনারেল তার পকেট থেকে একটি সোনার সিগারেট কেস বের করে তার অতিথিকে রুপালি টিপওলা একটি লম্বা কালো সিগারেট দিলেন; সুগন্ধি সিগারেট ধূপের মতো সৌরভ ছাড়ে।
জেনারেল বললেন, আমরা অত্যুত্তম শিকার করব আপনাতে-আমাতে। আপনার সঙ্গ পেলে আমি বড়ই আনন্দ লাভ করব।
কিন্তু কী ধরনের শিকার–
বলছি আপনাকে। আপনার খুব মজা লাগবে আমি জানি। সবিনয়ে বলছি, আমি একটি নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছি। আপনাকে আরেক গেলাস পোর্টওয়াইন দেব কি?
ধন্যবাদ, জেনারেল।
জেনারেল দুটি গেলাস পূর্ণ করে বললেন, ভগবান কোনও কোনও লোককে কবি বানান, কাউকে তিনি রাজা বানান, কাউকে ভিখিরি। আমাকে তিনি বানিয়েছেন শিকারি। আমার পিতা বলতেন, আমার হাতখানি বন্দুকের ঘোড়ার জন্য নির্মিত হয়েছিল। তিনি ছিলেন খুবই ধনী; ক্রিমিয়াতে তার আড়াই লক্ষ একর জমি ছিল এবং শিকারে ছিল তার চরম উৎসাহ আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ তখন তিনি আমাকে ছোট্ট একটি বন্দুক দেন বিশেষ অর্ডার দিয়ে সেটি মস্কোতে তৈরি করা হয়েছিল চড়ই শিকার করার জন্যে। আমি যখন ওইটে দিয়ে তার কতকগুলি জাত টার্কি মুরগি মেরে ফেলি তিনি তখন আমাকে কোনও সাজা দেননি; আমার আগের তিনি প্রশংসা করলেন। দশ বছর বয়সে ককেসাসে আমি আমার প্রথম ভালুক মারি। আমার সমস্ত জীবন একটানা একটা শিকার। আমি ফৌজে যোগ দিই– খানদানি ঘরের ছেলে মাত্রের কাছ থেকেই সে যুগে এই প্রত্যাশা করা হত এবং কিছুকালের জন্য আমি একটা ঘোড়সওয়ার কসাক ডিভিশনের কমান্ডারও হয়েছিলুম কিন্তু আমার সত্যকার আকর্ষণ সর্বসময়ই ছিল শিকার। সর্বদেশে আমি সর্বপ্রকারের জন্তু শিকার করেছি। আমি কটা জন্তু মেরেছি সেটা আপনাকে গুনে বলা আমার পক্ষে অসম্ভব।
রাশা যখন তছনছ হয়ে গেল তখন আমি দেশ ছাড়লুম। কারণ জারের একজন অফিসারের পক্ষে তখন সেখানে থাকা অবিবেচনার কাজ হত। অনেক খানদানি রাশান সর্বস্ব হারালেন। আমি কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে প্রচুর মার্কিন শেয়ার কিনে রেখেছিলুম। তাই আমাকে কখনও মন্টিকার্লোতে চায়ের দোকান করতে হবে না, বা প্যারিসে ট্যাক্সি ড্রাইভার হতে হবে না। অবশ্য আমি শিকার চালিয়ে যেতে লাগলুম। আপনাদের রকি অঞ্চলে গ্রিজলি, গঙ্গায় কুমির, পূর্ব আফ্রিকায় গণ্ডার। আফ্রিকাতেই ওই কেপ মহিষ আমাকে জখম করে ছ মাস শয্যাশায়ী করে রাখে। সেরে ওঠামাত্রই আমি আমাজনে জাগুয়ার শিকার করতে বেরোলুম, কারণ আমি শুনেছিলুম যে, তারা অসাধারণ ধূর্ত হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কসাক বললেন, মোটেই না। বুদ্ধি সজাগ রাখলে আর জোরদার রাইফেল থাকলে তারা কোনও শিকারির সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে না। আমি মর্মান্তিক নিরাশ হলুম। এক রাত্রে আমি তাঁবুতে শুয়ে অসহ্য মাথাব্যথায় কষ্ট পাচ্ছি এমন সময় একটা ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা আমার মাথায় ঢুকল। শিকার আমার কাছে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। এবং মনে রাখবেন শিকারই ছিল আমার জীবন। শুনেছি, মার্কিন দেশে ব্যবসায়ীরা আপন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে প্রায়ই যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েন, কারণ এই ব্যবসায়ই ছিল ওদের জীবন।