দরজার কড়া উপরের দিকে তুলে ঘা মারতে গেলে সেটা চড়চড় করল; রেনসফর্ডের মনে হল ওটা যেন কখনও ব্যবহার করা হয়নি। কড়াটা ছেড়ে দিতেই সেটা এমনই সুগুরুগম্ভীর নিনাদ ছাড়ল যে, রেনসফর্ড নিজেই চমকে উঠল। তার মনে হল ভিতরে যেন কার পায়ের শব্দ শুনতে পেল দরজা কিন্তু খুলল না। সে তখন আবার কড়া তুলে ছেড়ে দিল। তখন এমনই হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল যে তার মনে হল যে দরজাটা যেন স্প্রিং দিয়ে তৈরি। ঘরের ভিতর থেকে সোনালি অত্যুজ্জ্বল আলোর বন্যাধারা তার চোখ যেন ধাধিয়ে দিল। তার ভিতর দিয়ে রেনসফর্ড সর্বপ্রথম যা দেখতে পেল সেটা তার জীবনে এ পর্যন্ত দেখার মধ্যে সর্ববৃহৎ মনুষ্য কলেবর বিরাট দৈত্যের মতো আকার-প্রকার, নিরেট দড় মালে তৈরি, আর কোমর অবধি নেমে এসেছে কালো দাড়ি। তার হাতে লম্বা নলওলা রিভলভার আর সেটা সে নিশানা করেছে সোজা রেনসফর্ডের বুকের দিকে।
সেই দাড়ির জঙ্গলের ভিতর থেকে দুটি ছোট্ট চোখ রেনসফর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।
ভয় পেয়ো না বলে রেনসফর্ড স্মিত হাস্য করল; তার মনে আশা ছিল যে ওই স্মিতহাস্য লোকটার মনের সন্দেহ দূর করে দেব। আমি ডাকাত নই। একটা ইয়ট থেকে সমুদ্রে পড়ে গিয়েছিলুম, আমার নাম সেঙ্গার রেনসফর্ড-নিউ ইয়র্কের।
কিন্তু লোকটার ভীতি-উৎপাদক দৃষ্টির কোনও পরিবর্তন হল না। রিভলভারটা নড়নচড়ন না করে ঠিক তেমনি তার বুকের দিকে নিশান করে রইল, যেন দৈত্যটা পাথরে তৈরি। রেনসফর্ডের কথাগুলো যে সে বুঝতে পেরেছে তারও কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। এমনকি সে আদপেই শুনতে পেয়েছে কি না তা-ই বোঝা গেল না। লোকটার পরনে কালো উর্দি তার শেষ প্রান্তে বাদামি রঙের আস্ত্রাখান লোমের ঝালর।
রেনসফর্ড আবার শুরু করল, আমি নিউ ইয়র্কের সেঙ্গার রেনসফর্ড। আমি একটা ইয়ট থেকে পড়ে গিয়েছিলুম। আমার ক্ষিধে পেয়েছে।
লোকটা উত্তরে শুধু বুড়ো আঙুল দিয়ে রিভলভারের ঘোড়াটা তুলল। তার পর রেনসফর্ড দেখল যে, লোকটার খালি হাতখানা মিলিটারি সেলাম দেবার কায়দায় কপাল ছুঁল, এক জুতো দিয়ে অন্য জুতো ক্লিক করে এটেনশনে দাঁড়াল। আরেকজন লোক চওড়া মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন। ইভনিং ড্রেস পরা একদম খাড়া, পাতলা ধরনের লোক।
বিখ্যাত শিকারি সেঙ্গার রেনসফর্ডকে আমার বাড়িতে শুভাগমন জানাতে পেরে আমি আনন্দ ও গর্ব অনুভব করছি। চোস্ত খানদানি গলায় লোকটি কথাগুলো বললেন। তাতে বিদেশি উচ্চারণের সামান্য আমেজ ছিল বলে কথাগুলো যেন আরও সুস্পষ্ট, সুচিন্তিত বলে মনে হল।
আপনা-আপনি যেন রেনসফর্ড তাঁর সঙ্গে করমর্দন করল।
লোকটি বুঝিয়ে বললেন, তিব্বতে বরফের চিতেবাঘ শিকার সম্বন্ধে আমি আপনার বই পড়েছি, বুঝলেন তো। আমার নাম জেনারেল জারফ।
রেনসফর্ডের প্রথম ধারণাই হল যে, লোকটি অসাধারণ সুপুরুষ। দ্বিতীয় হল যে জেনারেলের চেহারায় যেন এক অপূর্ব অনন্যতা, প্রায় বলা যেতে পারে বিচিত্র ধরন রয়েছে। লোকটি প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে গেছেন, কারণ তার চুল ধবধবে সাদা কিন্তু তার ঘন জ্ঞ, আর মিলিটারি কায়দায় উপরের দিকে তোলা ছুঁচল গোঁফ মিশমিশে কালো– যেন ঠিক সেই অন্ধকারের কালো যার ভিতর থেকে রেনসফর্ড এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে। তার চোখদুটোও মিশমিশে কালো আর অত্যন্ত উজ্জ্বল। গালের হাড়দুটো তাঁর উঁচু, নাকটি টিকলো আর মুখ শীর্ণ ধরনের ঈষৎ বাদামি– এ ধরনের চেহারা হুকুম দিতে অভ্যস্ত খানদানি লোকের চেহারা। জেনারেল সেই উর্দি-পরা দৈত্যটার দিকে তাকিয়ে ইশারা করাতে সে তার পিস্তল নামিয়ে নিয়ে তাঁকে সেলুট করে চলে গেল।
জেনারেল বললেন, ইভানের গায়ে অসুরের মতো অবিশ্বাস্য শক্তি, কিন্তু বেচারির কপাল মন্দ– সে বোৰা আর কালা। সরল প্রকৃতির লোক, কিন্তু সত্যি বলতে কী তার জাতের আর-পাঁচজনের মতো একটুখানি বর্বর।
লোকটা কি রাশান?
জেনারেল স্মিত হাস্য করাতে তার লাল ঠোঁট আর উঁচল দাঁত দেখা দিল। বললেন, কসাক। আমিও। তার পর বললেন, চলুন, এখানে আর কথাবার্তা নয়। আমরা পরে সেটা করতে পারব। আপনার এখন প্রয়োজন জামাকাপড়, আহারাদি এবং বিশ্রাম। সব পেয়ে যাবেন। এ জায়গাটি পরিপূর্ণ শান্তিময়।
ইভান আবার দেখা দিল। জেনারেল তার সঙ্গে কথা কইলেন, সুদ্ধমাত্র ঠোঁট নেড়ে, কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে।
জেনারেল বললেন, আপনি দয়া করে ইভানের সঙ্গে যান। আপনি যখন এলেন তখন আমি সবেমাত্র ডিনারে বসেছিলুম। এখন আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আমার জামাকাপড় আপনার গায়ে ফিট করবে মনে হচ্ছে।
বরগাওলা বিরাট এক বেডরুম, টোপরওলা যে বিছানা তাতে ছ জন লোক শুতে পারে– সেখানে গিয়ে পৌঁছল রেনসফর্ড নীরব-দৈত্যের পিছনে পিছনে। ইভান একটি ইভনিং ড্রেস বের করে দিল। পরার সময় রেনসফর্ড লক্ষ করল স্যুটে লন্ডনের যে দর্জির নাম সেলাই করা রয়েছে তারা সাধারণত ডিউকের নিচের পদবির কারও জন্য স্যুট সেলাই করে না।
যে ডাইনিংরুমে ইভান তাকে নিয়ে গেল সেটাও বহুদিক দিয়ে লক্ষণীয়। ঘরটায় যেন ছিল মধ্যযুগীয় আড়ম্বর। দেয়ালে ওক কাঠের আস্তর, উঁচু ছাদ, বিরাট খাবার টেবিলে দু কুড়ি লোক খেতে পারে এসব সামন্তযুগের কোনও ব্যারনের হলঘরের মতো দেখাচ্ছিল। দেয়ালে লাগানো ছিল নানা প্রকারের পশুর মাথা– সিংহ, বাঘ, হাতি, ভালুক। এমন সর্বাঙ্গসুন্দর এবং বৃহৎ নমুনা রেনসফর্ড ইতোপূর্বে আর কখনও দেখেনি। সেই বিরাট টেবিলে জেনারেল একা বসে।