রেনসফর্ড একটা শব্দ শুনতে পেল। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে উচ্চকণ্ঠে পরিত্রাহি চিৎকারের শব্দ। কঠোরতম যন্ত্রণা ও ভীতির চিৎকার।
কোন প্রাণী এ আরব ছাড়ল সে সেটাকে চিনতে পারল না চেষ্টাও করল না। নবোদ্যমে সেই চিৎকারের দিকে সাঁতার কেটে এগুতে লাগল। সেটা সে আবার শুনতে পেল। এবারে সেটা অন্য একটা ছোট্ট, হঠাৎ বেজে-ওঠা শব্দে অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
সাঁতার কাটতে কাটতে মৃদুকণ্ঠে রেনসফর্ড বলল, পিস্তলের শব্দ।
আরও দশ মিনিট অধ্যবসায়ের সঙ্গে সাঁতার কাটার পর রেনসফর্ডের কানে আরেকটা ধ্বনি এল–জীবনে সে এরকম মধুর ধ্বনি আর কখনও শোনেনি– পাহাড়ি বেলাভূমির উপর ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার মূৰ্ছনা এবং গুমরানো। পাড়ের পাথরগুলো দেখার পূর্বেই প্রায় সে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে; রাত্রি অতখানি শান্ত না হলে ঢেউগুলো তাকে আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে দিত। অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে সে কোনও গতিকে ঢেউয়ের দ থেকে নিজেকে টেনে তুলল। এবড়ো-খেবড়ো পাথরের পাড় বেরিয়ে এসেছে নিরেট অন্ধকার থেকে! দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে সে উপরের দিকে চড়তে আরম্ভ করল। হাত তার ছড়ে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে উপরের সমভূমিতে এসে পৌঁছল। গভীর জঙ্গল সেই পাথুরে পাড়ের শেষ সীমা অবধি পৌঁছেছে। এই জঙ্গল আর ঝোঁপঝাড়ের ভিতর তার জন্য অন্য কোনও বিপদ আছে কি না, সে চিন্তা রেনসফর্ডের মনে অন্তত তখন উদয় হল না। তার মনে তখন শুধু ওইটুকু যে, সে তার শত্রু সমুদ্রের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে আর তার সর্বাঙ্গে অসীম ক্লান্তি। জঙ্গলের প্রান্তে সে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে তার জীবনের গভীরতম ন্দ্রিায় ডুবে গেল।
যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরাহু শেষ হয় হয়। নিদ্রা তাকে নবীন জীবনরস দিয়েছে আর তীক্ষ্ণ ক্ষুধায় পেট কামড়াতে আরম্ভ করেছে। প্রায় আনন্দের সঙ্গেই সে চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখল।
রেনসফর্ড চিন্তা করল, যেখানে পিস্তলের শব্দ হয় সেখানে মানুষ আছে। আর যেখানে মানুষ আছে সেখানে খাদ্যও আছে। কিন্তু প্রশ্ন, কীরকমের মানুষ এরকম ভীষণ জায়গায় থাকে–এ চিন্তাও তার মনে উদয় হল। কারণ চোখের সামনেই একটানা আঁকাবাকা শাখা, এবড়ো-খেবড়ো জড়ানো গুল্মলতা এক্কেবারে পাড় পর্যন্ত।
ঠাসবুনোটের লতাপাতা আর গাছের ভিতর দিয়ে সে সামান্যতম পায়ে চলার চিহ্ন বা পথও দেখতে পেল না। তারচেয়ে একেবারে পাড়ের উপর দিয়ে সমুদ্রের কাছে কাছে এগিয়ে যাওয়াই সহজ। হোঁচট খেয়ে খেয়ে সে এগুতে লাগল। যেখানে সে প্রথম পাড়ে নেমেছিল তার অদূরেই সে দাঁড়াল।
নিচের ঝোপে কোনও আহত প্রাণী চিহ্ন থেকে মনে হল বড় আকারেরই– আছাড়ি-বিছাড়ি খেয়েছে। জঙ্গলের লতাপাতা ছিঁড়ে গিয়েছে আর শ্যাওলা থেতলে গিয়েছে। একটা জায়গা রক্তরাঙা। একটু দূরেই কী একটা চকচকে জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তুলে দেখল কার্তুজের খোল।
রেনসফর্ড আপন মনে বলল, বাইশ নম্বরের। কীরকম অদ্ভুত ঠেকছে। আর ওই শিকারটা বেশ বড় ছিল বলেই তো মনে হচ্ছে। খুবই ঠাণ্ডা মাথার শিকারি ছিল বলতে হবে যে তার সঙ্গে ওই ছোট্ট হাতিয়ার নিয়ে মোকাবেলা করল। আর এটাও তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে জন্তুটা বেশ লড়াইও দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, প্রথম যে তিনটে শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম তখন শিকারি তাকে দেখতে পেয়ে তিনটে গুলি ছুঁড়ে তাকে জখম করেছিল। তার পর তার পালিয়ে যাবার চিহ্ন ধরে ধরে এখানে এসে তাকে খতম করেছে। শেষ আওয়াজ যেটা শুনতে পেয়েছিলুম সেটা সে-ই।
রেনসফর্ড জমিটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করে যা দেখতে পাবার আশা করেছিল তাই পেল শিকারির জুতোর চিহ্ন। সে যেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল জুতোর চিহ্ন সেই দিকেই গিয়েছে। উদগ্রীব প্রতীক্ষায় সে এগিয়ে চলল। কখনও-বা পচা গাছের গুঁড়ি বা আধখসা পাথরে সে পিছলে যাচ্ছিল, কিন্তু অগ্রসর হচ্ছিল ঠিকই। দ্বীপের উপর তখন রাত্রির অন্ধকার আস্তে আস্তে নেমে আসছে।
রেনসফর্ড যখন প্রথম আলোকগুলো দেখতে পেল তখন ঠাণ্ডা অন্ধকার সমুদ্র আর জঙ্গলটাকে কালোয় কালোময় করে দিচ্ছিল। বেলাভূমির একটা বেঁকে-যাওয়া জায়গায় মোড় নিতে সে সেগুলো দেখতে পেল এবং প্রথমটায় তার মনে হয়েছিল, সে কোনও গ্রামের কাছে এসেছে– কারণ আলো দেখতে পেয়েছিল অনেকগুলো। কিন্তু ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখে বিস্মিত হল যে সবকটা আলো আসছে একই বিরাট বাড়ি থেকে প্রকাণ্ড উঁচু বাড়ি, তার চুল মিনারের মতো টাওয়ার উপরের অন্ধকারের দিকে ঠেলে ধরেছে। বিরাট দুর্গের মতো রাজপ্রাসাদের (শাটো) আকার প্রচ্ছায়া তার চোখে ধরা পড়ল এবং দেখল শাটোটি একটি উঁচু জায়গার উপর নির্মিত। তার তিন দিকে খাড়া পাহাড়ের পাঁচিল সমুদ্র পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। সেখানে কালো ছায়াতে ক্ষুধার্ত সমুদ্র যেন। দেওয়ালগুলো ঠোঁট দিয়ে চাটছে।
মরীচিকাই হবে– ভাবল রেনসফর্ড। কিন্তু যখন সে বাড়িটার ফলকওলা গেটটা খুলল তখন বুঝল যে মোটেই মরীচিকা নয়। পাথরের সিঁড়িগুলোও যথেষ্ট বাস্তব; পুরু ভারী পাল্লার দরজাও যথেষ্ট বাস্তবতার গায়ে রয়েছে দৈত্যমুখাকৃতি কড়া–কিন্তু তবু কেমন যেন সমস্ত জায়গাটার চতুর্দিকে অবাস্তবতার বাতাবরণ।