গাঁজা!– হেসে উঠল রেনসফর্ড। গরমে তোমার মগজ গলে যাচ্ছে–বুঝলে উইটনি? বাস্তববাদী হতে শেখ। পৃথিবীতে দুটি শ্রেণি আছে। শিকারি আর শিকার। কপাল ভালো যে তুমি-আমি শিকারি। আচ্ছা, আমরা কি ওই দ্বীপটা পেরিয়ে এসেছি।
অন্ধকারে বলতে পারব না। আশা তো করছি তা-ই।
কেন?
জায়গাটার নাম আছে- বদনাম।
নরখাদক আছে ওখানে?
তার সম্ভাবনা অল্পই। এমন লক্ষ্মীছাড়া জায়গাতে ওরাও থাকতে যাবে না। কিন্তু বদনামটা খালাসি-মাঝিদের মধ্যে যে করেই হোক রটে গেছে। লক্ষ করনি আজ ওরা কীরকম যেন এক অজানা আতঙ্কে সন্ত্রস্ত ছিল?
তোমার বলাতে এখন মনে হচ্ছে, কেমন যেন তাদের ধরনধারণ আজ অন্য রকমের ছিল। কাপ্তান নিলসেন পর্যন্ত
হ্যাঁ, এমনকি ওই যে তাগড়া কলিজার বুড়ো সুইড় নিলসেন–খুদ শয়তানের কাছে গিয়ে যে নির্ভয়ে দেশলাইটি চাইতে পারে, মাছের মতো অসাড় তার নীল চোখেও আজ এমন ভাবের পরিবর্তন লক্ষ করলুম, যেটা পূর্বে কখনও দেখিনি। যেটুকু বলল তার মোদ্দা, খালাসি-লস্করদের ভিতর এ জায়গাটার ভারি দুর্নাম। তার পর অত্যন্ত গম্ভীরভাবে আমাকে শুধোল, কেন, আপনি কিছু টের পাচ্ছেন না? যেন আমাদের চতুর্দিকের আকাশ-বাতাস বিষে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। দেখ, ওই নিয়ে কিন্তু হেসে উঠ না, যদি বলি আমারও সর্বাঙ্গ যেন হঠাৎ হিম হয়ে গেল। ওই সময়ে কোনও বাতাস বইছিল না। ফলে সমুদ্র জানালার শার্শির মতো পালিশ দেখাচ্ছিল। আমরা তখন ওই দ্বীপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। আমার মনে হচ্ছিল আমার বুকটা যেন শীতে জমে হিম হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ যেন এক অজানা ত্রাসে।
রেনসফর্ড বলল, নির্ভেজাল আকাশ-কুসুম! একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নাবিক সমস্ত জাহাজের নাবিকদের মাঝে ভয় ছড়িয়ে দিতে পারে।
তাই হয়তো হবে। কিন্তু জান, আমার মনে হয়, নাবিকদের যেন একটা আলাদা ইন্দ্রিয় আছে, যেটা বিপদ ঘনিয়ে এলে তাদের জানিয়ে দেয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অমঙ্গল। যেন একটা বাস্তব পদার্থ ধ্বনি বা আলোর থেকে যেরকম তরঙ্গ বেরোয়, অমঙ্গলের শরীর থেকেও ঠিক তেমনি। সে ভাষায় বলতে গেলে বলব, অমঙ্গলের পাপভূমি যেন বেতারে অমঙ্গল ছড়ায়। তা সে যা-ই হোক, এ এলাকাটা ছাড়িয়ে যেতে পারছি বলে আমি খুশি। যাক গে, আমি এখন শুতে চললুম, রেনসফর্ড।
রেনসফর্ড বলল, আমার এখনও ঘুম পায়নি। পিছনের ডেকে বসে আমি আরেকটা পাইপ টেনে নিই।
তা হলে গুডনাইট, রেনসফর্ড। কাল ব্রেকফাস্টে দেখা হবে।
ঠিক আছে! গুডনাইট, উইটনি।
রাত্রি নিস্তব্ধ নীরব। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে যে ইঞ্জিন ইয়টটিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল শুধু তারই চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছিল আর তার সঙ্গে প্রপেলারের মার খেয়ে জলের শব্দ।
ডেক্ চেয়ারে হেলান দিয়ে অলসভাবে রেনসফর্ড তার শখের ব্রায়ার পাইপে টান দিচ্ছিল। রাত্রি যেন ঘুমের ঢুলুঢুলু ভাব তার শরীরে আবেশ লাগাচ্ছিল। আপন মনে চিন্তা করল, রাতটা এমনই অন্ধকার যে মনে হয় চোখের পাতা বন্ধ না করেই ঘুমুতে পারব; রাতটিই হবে আমার চোখের পাতা
হঠাৎ একটা আওয়াজ এসে তাকে চমকে দিল। ডানদিক থেকে শব্দটা এসেছিল। এসব ব্যাপারে সে সজাগ, সবকিছু ঠিক ঠিক জানে। তার কান ভুল করতে পারে না। আবার সে সেই শব্দটা শুনতে পেল, তার পর আবার। ওই দূরের অন্ধকারে কে যেন তিনবার গুলি ছুঁড়েছে।
কী রহস্য বুঝতে না পেরে রেনসফর্ড লাফ দিয়ে উঠে ঝটিতি রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। যেদিক থেকে শব্দটা এসেছে সেইদিকে যেন চোখ ঠেলে দিল; কিন্তু এ যেন কম্বলের ভিতর দিয়ে দেখবার নিষ্ফল প্রচেষ্টা। আরেকটু উঁচু থেকে দেখার জন্য সে রেলিঙের একটা রডে লাফ দিয়ে উঠে তার উপর দাঁড়াল। তারই ফলে একটা দড়িতে লেগে তার পাইপটা মুখ থেকে ঠিকরে পড়ে যেতে সেটাকে ধরবার জন্য সে ঝটিতি সামনের দিকে ঝুঁকতেই তার গলা থেকে কর্কশ আর্তনাদ বেরুল- কারণ সে তখন বুঝে গিয়েছে যে বড্ড বেশি এগিয়ে যাওয়ার ফলে সে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেছে। তার সে আর্তনাদ টুটি চেপে ধরে বন্ধ করে দিল ক্যারেবিয়ান সমুদ্রের কুসুম কুসুম গরম জল। তার মাথা পর্যন্ত তখন সে জলে ডুবে গিয়েছে।
যেন ধস্তাধস্তি করে সে জলের উপরে উঠে চিৎকার দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু ইয়টের দ্রুতগতির মারে ছুটে আসা জল যেন কষাল তার গালে চড় আর নোনা জল তার খোলা মুখের ভিতরে ঢুকে যেন তার টুটি চেপে ধরে বন্ধ করে দিল। দুবাহু বাড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে সে মরিয়া হয়ে ক্রমশ অদৃশ্যমান ইয়টের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল, কিন্তু পঞ্চাশ ফুট চলার পূর্বেই সে আর সে-চেষ্টা দিল না। ততক্ষণে তার মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে; জীবনে এই তার সর্বপ্রথম কঠিন সঙ্কট নয়। জাহাজের কেউ তার চিৎকার শুনতে পাবে সে সম্ভাবনা অবশ্য একটুখানি ছিল, কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং ইয়ট যতই দ্রুতগতিতে এগুতে লাগল সে সম্ভাবনা ততই ক্ষীণতর হতে লাগল। যেন পালোয়ানের মতো শক্তি প্রয়োগ করে সে নিজেকে তার জামাকাপড় থেকে মুক্ত করে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু ইয়টের আলো ক্ষীণতর হতে লাগল, যেন দূরের ক্রমশ অদৃশ্যমান জোনাকি পোকা। সর্বশেষে ইয়টের আলোকগুলোকে অন্ধকার যেন শুষে নিল।
ইয়টের ডেকে বসে রেনসফর্ড যে গুলি ছোঁড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল সেগুলো তার স্মরণে এল। সেগুলো এসেছিল ডানদিক থেকে। চরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে সে সেদিকে সাঁতার কাটতে লাগল ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি বাঁচিয়ে সে ভেবেচিন্তে হাত দুখানা ব্যবহার করছিল। ক-বার সে হাত ছুড়ছে সেটা সে শুনতে আরম্ভ করল; সম্ভবত সে আরও শ-খানেক বার হাত ফেলতে-টানতে পারবে, এমন সময়