আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ প্রাদেশিক ভাষাকে বর্জন করে নয়, তার সম্যক উন্নতি সাধন করে, এবং আমার আরও বিশ্বাস, প্রাদেশিক সংস্কৃতি নির্মাণ করলে বৃহত্তর ভারতীয় ঐক্য ক্ষুণ্ণ হবে না।
কারণ ভারতীয় ঐক্য (ইউনিটি) ও ভারতীয় সমতা (ইউনিফমিটি) এক বস্তু নয়। আজ যদি পাঞ্জাব থেকে আসাম অবধি সবাই ভাত খেতে আরম্ভ করে, তবে বিদেশ থেকে শস্য কেনার সময় আমাদের বহুং বখেড়া আসান হয়ে যাবে, আজ যদি তাবৎ ভারতীয়ের উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি হয়ে যায়, তবে সৈন্যদের ইউনিফর্ম বানাবার কত না সুবিধা! তবু কেউ বলবেন না, সবাইকে জোর করে ভাত খাওয়া, কিংবা ঢ্যাঙাদের শরীর থেকে দু ইঞ্চি কেটে ফেল। এ ইউনিটি নয়, ইউনিফরমিটি।
যারা মেরে-পিটে ভারতীয় সমতা চাইছেন, তারা যে জেনে-শুনে ভুল করেছেন তা–ও হতে পারে। আমার বিশ্বাস, তারা ইউনিটি চাইছেন সত্য, কিন্তু ইউনিটি এবং ইউনিফরমিটিতে গোল পাকিয়ে ফেলেছেন। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, প্রত্যেক ভারতীয় প্রদেশ যদি আপন প্রাদেশিক সংস্কৃতি সভ্যতা আপন শক্তি ও প্রতিভা দিয়ে গড়ে তোলে, তবে সেই সম্মিলিত সংস্কৃতিই হবে সত্যকার ভারতীয় সংস্কৃতি।
গুরু রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে নিবেদন করি, তিনি বলেছিলেন, একতারা বাজানো সহজ, বীণা বাজানো কঠিন; কিন্তু সেটা বাজাতে পারলে তার থেকে যে harmony বা বহুধ্বনি আপন আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ঐক্যের যে সঙ্গীত নির্মাণ করে তোলে, তার সঙ্গে একতারার ইউনিফমিটির কোনও তুলনা হয় না।
বহু প্রদেশের নানাবিধ সঙ্গীত জেগে উঠে যে harmony-র সৃষ্টি হবে, সে-ই সত্যকার ভারতীয় ঐক্য-সঙ্গীত। তবেই জনগণ ঐক্যবিধায়ক বলা সফল হবে।
.
০৫.
হিন্দির প্রসার এবং প্রচার অতীব প্রয়োজনীয়, সেকথা আমরা সকলেই স্বীকার করি কিন্তু সে প্রসার যেন প্রাদেশিক এবং আঞ্চলিক ভাষা এবং সাহিত্যকে গলা টিপে না মেরে ফেলে। হুশিয়ার হয়ে সে প্রসারকর্ম সমাধান করলে কারওরই কোনও আপত্তি থাকবে না। কী প্রকারে সেটা করা যেতে পারে, সে নিবেদন করার পূর্বে হিন্দির বিরুদ্ধে যে কয়টি আপত্তি বাঙলা দেশের কাগজে ইদানীং উঠেছে, তারই দু-একটি নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়োজন।
হিন্দির বিরুদ্ধে প্রধান এবং প্রথম আপত্তি, হিন্দির লিঙ্গ বিভাগটা বড়ই বদখদ। বাঙালি ভাবে, ছেলেটা যাচ্ছে, মেয়েটা যাচ্ছে বললে যখন দিব্য অর্থ বুঝতে পারি তখন লড়কা জাতা হৈ, লড়কি জাতি হৈ বলে মানুষকে বিরক্ত করা ছাড়া অন্য কোনও লাভ হয় না। এস্থলে বক্তব্য, অর্থ বুঝতে পারার মান নিয়েই ভাষা সৃষ্টি হয় না। তাই যদি হত তবে বাঙলায় বলি না কেন, আমি গেলুম তুমি গেলুম সে গেলুম? ইংরেজ তো খাসা এক ওয়েন্ট দিয়েই বলে যায়, আই ওয়েন্ট, ইউ ওয়েন্ট, হি ওয়েন্ট– অর্থ জলের মতো পরিষ্কার বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না।
অর্থাৎ প্রত্যেক ভাষারই আপন আপন বৈশিষ্ট্য থাকে এবং তা নিয়ে গোসা করলে চলে না। এখন প্রশ্ন, হিন্দি যে লিঙ্গভেদ করে সেটা কি নিছক তারই পাগলামি, না অন্যান্য ভাষাও করে বাঙলা এককালে কিছুটা করত, সেকথা সকলেই জানেন, এবং এখনও কিছুটা করে। সুন্দর রমণী বলতে এখনও বাধো বাধো ঠেকে, এবং কোনও রমণীকে যদি বলি, ওগো সুন্দর, গঙ্গাস্নানে চললে নাকি–তবে এখনও সেটা ভুল, সুন্দরী বলতে হয়।
সংস্কৃতে যে লিঙ্গভেদ আছে এবং সে লিঙ্গভেদ যে সরল নয়, সেকথাও সকলেই জানেন। প্রাণহীন বন্ধুমাত্রই যে ক্লীব হয় তা-ও তো নয়। বহু নদনদী এ জীবনে দেখেছি কিন্তু কোনটারই নাম পুংলিঙ্গ আর কোনটারই-বা স্ত্রীলিঙ্গ–ক্লীবের তো কথাই উঠে না– সে তত্ত্বটি জলধারা দেখে ঠাহর করতে পারিনি। দিসুন্দরীর (ডিকশনারির শরণাপন্ন হলে পর তিনি দিশেহারাকে দিক বাতলে দেন।
উত্তরে হয়তো বলবেন, সংস্কৃতের উদাহব্রণ এখন আর চলবে না। চাল ভাষা থেকে নজির পেশ কর।
এই মুশকিলে পড়ে গেলেন। ফরাসি, জর্মন, রুশ, ইতালি, ওলন্দাজ, আরবি, গুজরাতি, মারাঠি এ সব ভাষাতেই লিঙ্গভেদ আছে এবং আরও বহু ভাষায় আছে বলে শুনেছি, সত্য বলতে কি, লিঙ্গভেদ নেই এরকম ভাষাই বিরল। আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান বলে, বড় ভাষার ভিতরে তিনটিমাত্র ভাষাতে লিঙ্গবিচার নেই–ইংরেজি, ফারসি এবং বাঙলা। এ তিনটি ভাষা যতখানি ছাত্রাস ব্যাকরণ বর্জন করতে পেরেছে অন্য ভাষাগুলো সেরকম পারেনি।
জর্মনের লিঙ্গ সবচেয়ে বেতালা বেহিসাব। ছুরি কাটা এবং চামচ তিনটি শব্দই আমাদের কাণ্ডজ্ঞান অনুযায়ী ক্লীব হওয়া উচিত অথচ জর্মন ভাষাতে দুরি ক্লীব, কাটা স্ত্রীলিঙ্গ এবং চামচ পুলিঙ্গ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সূর্য স্ত্রীলিঙ্গ, ভ্র জ্যোৎস্না-পুলকিত যামিনীর চন্দ্রমা পুংলিঙ্গ এবং নারী (ডাস ভাইব, ভাইব–ওয়াইফ) ক্লীব লিঙ্গ! শুধু তাই নয়, সূর্যের চেয়েও দোর্দণ্ডপ্রতাপ জন পুলিশ বাহিনী (ডি পোলিসাই) স্ত্রীলিঙ্গ।
পুনরপি পশ্য, পশ্য, ফরাসি এবং হিন্দিতে দাড়ি স্ত্রীলিঙ্গ।
তবে কি দাড়ির জৌলুসের মালিক এককালে রমণীরা ছিলেন? পুরুষেরা পরবর্তী যুগে জোর করে কেড়ে নিয়েছেন। কিন্তু ভুলবেন না, গোঁফ হামেশাই দাড়ির উপরে।
তবে বলুন তো, ভদ্র হিন্দিকে দোষ দিয়ে লাভ কী? বরঞ্চ হিন্দি জর্মনের তুলনায় দ্রুতর। জনে তিনটি লিঙ্গ; লাগলে তাগ, না লাগলে তুক্কা করে যদি লিঙ্গবিচার করেন তবে শুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র শতকরা ৩৩.৩ ভাগ; হিন্দিতে ৫০ ভাগ, কারণ হিন্দিতে মাত্র দুটি লিঙ্গ।