অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখা ভাষা দিয়ে কোনও মরণ-বাচনের ব্যাপারে তর্কাতর্কি করা যায় না। সে ভাষা দিয়ে বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করা যায় ব্যস্।
আরেকটা উদাহরণ দিই। ইংলন্ড যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি পৌন্ড খরচা করেছে ইংরেজ ছোকরাদের ফরাসি শেখাবার জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। অথচ দশ হাজার ইংরেজ যদি প্যারিস বেড়াতে আসে তবে দশটা ইংরেজও ফরাসি বলতে পারে না।
সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বাপ, মা, ম্যাট্রিক পাস ব্যাটা নাবলেন ক্যালে বন্দরে। ইস্টিমারে ইংরেজি চলে, কোনও অসুবিধা হয়নি। ক্যালেতেও হবে না, বাপ-মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস, কারণ ছেলে ম্যাট্রিকে ফরাসিতে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। বাপ প্রতাপ রায়ের মতো ছেলে বরজলালকে হেসে বললেন, জিগ্যেস কর তো বাবাজি, পোর্টারটাকে প্যারিসের ট্রেন কটায় ছাড়বে?
ছেলে প্রমাদ গুনছে। বরজলালেরই মতো আপন ফরাসি ভাষার গুরুকে স্মরণ করে ক্ষীণ কণ্ঠে যখন পোর্টারকে বিদঘুঁটে উচ্চারণে জিগ্যেস করল, আকেল আর পার লা আঁ পুর পারি? তখন পোর্টার মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে হাঁ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, তার পর মিনিট তিনেক ঘাড় চুলকে চুলকে ভেবে নিল। হঠাৎ মুখে হাসি ফুটল। চিৎকার করে আরেকটা পোর্টারকে ডাক দিয়ে বলল, এ, জ্যা ভিয়ানিসি, ওয়ালা আ মসিয়ো কী পার্ল লাংলে। এই জন, এদিকে আয়, এক ভদ্রলোক ইংরেজি বলছেন। বুঝতে নারনু।
হায়, কিন্তু বেচারা ফাঁকি দিয়ে গোল্ড মেডেল মারেনি। ফরাসি ব্যাকরণ তার কণ্ঠস্থ, পাস্ট কন্ডিশনাল, ফুচার সবজনকটিভ তার নখদর্পণে– কিন্তু ফরাসি জাতটাই নচ্ছার, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিদেশির মুখে ভুল উচ্চারণে আপনার ভাষার শব্দরূপ ধাতুরূপ নতে কিছুতেই রাজি হয় না!
***
কিন্তু পাঠক নিরাশ হবেন না। পার্লিমেন্টে বক্তৃতার ভাষা-সমস্যা সমাধান করা যায়। পরে নিবেদন করব।
.
০৪.
ভারতের ভবিষ্যৎ বৈদগ্ধ্য সংস্কৃতি কী রূপ নেবে, সে সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ হলেই দেখতে পাই অনেকেই মনে মনে আশা পোষণ করছেন, সে বৈদগ্ধ্য যেন ঐক্যসূত্রে তাবৎ প্রদেশগুলোকে সম্মিলিত করে নব নব বিকাশের দিকে ধাবিত হয়। এ অতি উত্তম প্রস্তাব এবং এতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। যখন ভাবি, এই ভারতবর্ষেই একদা একই সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে কাবুল থেকে কামরূপ, হরিদ্বার থেকে কন্যাকুমারী সর্ব কলাপ্রচেষ্টা সর্ব জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে, তখনই ঐক্যাভিলাষী হৃদয় উল্লসিত হয়ে ওঠে, আর তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায়।
সংস্কৃতকে ব্যাপকভাবে পুনরায় সেরকম ধারায় চালু করার আশা আর কেউ করেন না। এখন প্রশ্ন, হিন্দির মাধ্যমে সেটা সম্ভবপর কি না?
এই মনে করুন রামের সুমতি কিংবা বিন্দুর ছেলে। ধরে নিন অতি উত্তম অনুবাদক বই দুখানা হিন্দিতে অনুবাদ করলেন। আপনি উত্তম না হোক মধ্যম ধরনের হিন্দি জানেন, অর্থাৎ হিন্দি পুস্তকমাই দিব্য গড়গড় করে পড়ে যেতে পারেন। এখন প্রশ্ন, আপনি কি সে সুখটা পাবেন যে সুখ ওই দু-খানা বাঙলা বই বাঙলাতে পড়ে পান (গোরার ইংরেজি তর্জমা পড়েছেন? তাতে তো কোনও সুখই পাওয়া যায় না–কারণ ইংরেজি অতি-দূরের ভাষা) কেন পান না? তার প্রধান কারণ বিন্দু কী ভাষায়, কী ভঙ্গিতে কথা বলে, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে আপনার পরিচয় আছে; যখন দেখবেন তার সঙ্গে কিছুই মিলছে না, সবই কৃত্রিম বোধ হচ্ছে, তখন আপনার কাব্যরসাস্বাদনের সব বাসনা চিরতরে না হোক, তখনকার মতো লোগ পাবে। সংস্কৃতে যারা নাটক লিখে গিয়েছেন, তারা এ তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানতেন, তাই অন্তত মেয়েদের দিয়ে সংস্কৃত বলাননি, বলিয়েছেন প্রাকৃত। নৃপ ব্রাহ্মণ সংস্কৃত বলেছেন, কারণ তারা সংস্কৃত বলতে পারতেন, কিন্তু গোরা, বিনয়, অমিট রে কেউই দৈনন্দিন জীবনে হিন্দি বলেন না, কখনও বলবেন বলে মনে হয় না। কাজেই হিন্দি দিয়ে এদের চরিত্র বিকাশ করে বাঙালিকে সুখ দেওয়া যাবে না। যাদের মাতৃভাষা বাঙলা নয়, তাঁদের কথা আলাদা– তাঁরা অবশ্য অনেকখানি রস পাবেন– যদিও স্বামী বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন, অনুবাদ সাহিত্যমাত্রই কাশ্মিরি শালের উল্টো দিকের মতো, মূল নকশাটি বোঝা যায় মাত্র, আর সব রসের কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না।*[* সত্যই স্বামীজি বলেছেন কি না, হলপ করে বলতে পারব না; এক গুণীর মুখে শোনা।]
উপরিস্থ তত্ত্বকথাটি সকলের কাছে এতই সুপরিচিত যে, আমার পুনরাবৃত্তিতে অনেকেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন, কিন্তু এইটির ওপর নির্ভর করে আমি যে বক্তব্য পেশ করব, সেটা যদি সকলে গ্রহণ করেন কিংবা অন্ততপক্ষে সেটি বিবেচনাধীন করেন, তবে আমি শ্রম সফল বলে মানব।
শুধু ভাষা এবং সাহিত্য নয়, অন্যান্য প্রচেষ্টাও স্বভাবতই প্রাদেশিক রঙ নেয়। অজন্তা ও মোগল-শৈলীর নবজীবন লাভ হয় বাঙলা দেশে, তাই সে সম্বন্ধে যত আলোচনা-গবেষণা হয়েছে তার অধিকাংশই বাঙলাতে। অর্থাৎ প্রাদেশিক ভাষাকে একবার সার্বভৌম অধিকার দিলে যে বৈদগ্ধ্য গড়ে উঠে, সেটা প্রাদেশিক।
এইখানে লেগে গেল দ্বন্দ্ব। আমরা এ প্রবন্ধ প্রারম্ভ করেছি প্রতিজ্ঞা নিয়ে, ভারতীয় বৈদগ্ধ্য যেন ঐক্যসূত্রে তাবৎ প্রদেশগুলোকে সম্মিলিত করে নব নব বিকাশের দিকে ধাবিত হয়। তা হলে মুক্তি কোন পন্থায় প্রাদেশিক ভাষাকে সংস্কৃতি জগতের চক্রবর্তীরূপে স্বীকার করে প্রাদেশিক সংস্কৃতি গড়ব, না বাঙলা বর্জন করে হিন্দির মাধ্যমে ভারতীয় ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতির সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করব?