আমাদের প্রাদেশিক সাহিত্যের যে ক্ষতি হবে সেকথা এখন থাক। উপস্থিত মোদ্দাকথা হচ্ছে এই, ভারতীয় নবীন রাষ্ট্রনির্মাণ সম্বন্ধে গবেষণা, আলোচনা, তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ যেসব গ্রামভারি কেতাব, ব্লু বুক, দলিল-দস্তাবেজ, উৎসাহহাদ্দীপক ওজস্বিনী এবং গম্ভীর পুস্তক রচিত হবে সেগুলো হবে হিন্দিতে এবং দেশের শতকরা সত্তরজন লোক গ্রামে বসে সেগুলো পড়তে পারবে না।
একদা এই সত্তরজন লোকের প্রয়োজন হয়েছিল ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র এই সত্তরজনকে বাদ দিয়ে নির্মাণ করা যাবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাবৎ কেতাব বাঙলাতে লিখলৈই কি এরা সেগুলো পড়ে বুঝতে পারবে? সে সম্বন্ধে আমার কিঞ্চিৎ নিবেদন আছে। আমার বিশ্বাস, দেশ সম্বন্ধে জ্ঞান সঞ্চয় সবসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ছাপের ওপর নির্ভর করে না। এমন সব ইংরেজি-অনভিজ্ঞ, অর্থাৎ সুদ্ধ বাঙলা-ভাষী পাঠশালার পণ্ডিত আছেন, যারা দেশের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন আছেন বলে এবং বাংলা দৈনিকের মারফতে অতি অল্প যে রাষ্ট্রসংবাদ পান তারই জোরে গ্র্যাজুয়েটকে তর্কে ঘায়েল করতে পারেন। অনেক এম.এ. পাস লোক বই জমায় না– জমালে জমায় চেক বুক আর অনেক পাঠশালার পণ্ডিত গোগ্রাসে যে কেতাব পান তাই গেলেন। পুনরায় নিবেদন করি, জ্ঞানতৃষা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির ওপর নির্ভর করে না।
তাই দেখতে হবে আমাদের রাষ্ট্রনির্মাণ প্রচেষ্টার সর্বসংবাদ যেন এমন ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যে ভাষা মানুষের মাতৃভাষা। ইংরেজ আমলে ইংরেজি জাননেওয়ালা ও না-জাননেওয়ালার মধ্যে যে ন্যক্কারজনক কৌলীন্যের পার্থক্য ছিল সেটা যেন আমরা জেনেশুনে আবার প্রবর্তন না করি।
.
০৩.
সুশীল পাঠক, মাঝে মাঝে ধোঁকা লাগে, রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে এই যে আমি হপ্তার পর হপ্তা দাপাদাপি করছি তাতে তুমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছ না তো? আমি তো হয়ে গিয়েছি কিন্তু বিষয়টি বড্ডই গুরুত্ব্যঞ্জক এবং আমার বিশ্বাস, ভারতবর্ষের শুধু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছে না, আমাদের অতীত ঐতিহ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ বৈদগ্ধ সংস্কৃতি সবকিছুই এর ওপর নির্ভর করছে। একবার যদি ভুল রাস্তা ধরি তবে আমড়াতলার মোড়ে ফিরে আসতেই আমাদের লেগে যাবে বহু যুগ এবং তখন আবার নতুন করে সবকিছু ঢেলে সাজাতে গিয়ে প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। আজকের দিনে পৃথিবীতে কেউ বসে নেই–তখন দেখতে পাবেন, আর সবাই এগিয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ রাজনীতিতে আপনি অমুক দেশের ধামাধরা হয়ে আছেন, অর্থনীতিতে আপনি আর এক মুল্লুকের কাছে সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েছেন এবং কৃষ্টি সংস্কৃতিতে নিরেট হটেন্টট বনে গিয়েছেন।
কেন্দ্রের ভাষা যে হিন্দি হবে সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিষদের ভাষা হবে কী? অর্থাৎ প্রশ্ন, পার্লিমেন্টে সদস্যেরা বক্তৃতা দেবেন কোন ভাষায়?
হিন্দিওয়ালা হিন্দিতে দেবেন– বাঙলা কথা। কিন্তু তামিল-ভাষীরা দেবেন কোন ভাষায়?
এতদিন একদিক দিয়ে আমাদের কোনও বিশেষ হাঙ্গামা ছিল না। সব প্রদেশের সদস্যরা ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন–অথচ কারওরই মাতৃভাষা ইংরেজি ছিল না বলে অহেতুক সুবিধা কেউই পেত না। এবং যে সুবিধাটা পেত ইংরেজ রাজসম্প্রদায় এবং তারা যে সে সুযোগটা ন-সিকে কাজে লাগাত সেকথাও সবাই জানেন।
এখন অবস্থাটা হবে কী? কেঁদে-ককিয়ে যেটুকু হিন্দি শিখব তার জোরে কি পার্লিমেন্টে বক্তৃতা ঝাড়া যায়? পূর্বেই নিবেদন করেছি, হিন্দিকে যদি তিরুঅনন্তপুরম (ত্রিভান্দরম) কিংবা বিশাখাপট্টনম (ভাইজাগ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম করা হয় (কলকাতা কিছুতেই মানবে না, সে আপনি-আমি বিলক্ষণ জানি। তবে তাদের আখেরটি ঝরঝরে হয়ে যাবে। অতএব অস্ত্র, তামিলনাড়ু, কেরালার লোক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে যেটুকু হিন্দি শিখবে– (সবাই শিখবে তা-ও নয়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না-ও শিখতে পারে তা দিয়ে কি সে হিন্দি-ভাষীদের সঙ্গে বাকযুদ্ধ চালাতে পারবে?
দু দণ্ড রসালাপ সব ভাষাতেই করা যায়। আমি তোমায় ভালোবাসি, জ্য তেম, ইস লিবে ডিস–আহা এসব কথা দেখতে না দেখতেই শিখে ফেলা যায়। মদন যেস্থলে শুরু, সখা কন্দর্পও হয়তো মজুত, কালটি মধুমাস, উর্বশী দু-চকর নাচভি দেখিয়ে দিচ্ছেন, তার মধ্যিখানে সবাই এক লহমায় হরিনাথ দে হয়ে যান। কিংবা বলতে পারেন, সেখানে ভাষার দরকারই-বা কী– কোন প্রয়োজন মধুর ভাষণের
কিন্তু পার্লিমেন্টে তো মানুষ রসালাপ করতে যায় না। সেখানে লাগে স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত, চিন্তাধারা-চিন্তাধারায় টক্কর লেগে উঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি, বাজেটকে বাক্যবাণে জর্জরিত করতে হয় যেখানে-সেখানে করেঙ্গা, খায়েঙ্গা হিন্দি দিয়ে কাজ চলে না। আমাদের বাঙাল দেশে বলে ছাগল দিয়ে হাল চালাবার চেষ্টা কর না।
বিচক্ষণ পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, ঘড়েল প্যাসেঞ্জার কখনও, অর্থাৎ কাইট্যা ফালাইলেও বেহারি মুটের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্ক করার সময় হিন্দি বলে না। কারণ সে একখানা বলতে না বলতে মুটে ঝেড়ে দেবে পাঁচখানা পুরো পাচালী এবং লক্ষ করেছ, মুটেও ততোধিক ঘড়েল– দিব্য বাঙলা জানে, কিন্তু মেশিনগান চালাচ্ছে তার বিহারি হিন্দি করত, খাওত, আর ভজলু কি বহিনিয়া ভগলু কি বেটিয়ার ভাষা দিয়ে।