সোনা-মুগ সরু চাল সুপারি ও পান,
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিধান
গুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল
আমসত্ত্ব আমচুর—
ইত্যাদি মাথায় থাকুন, বিছানাটি যে নিয়ে যাবেন তারও উপায় নেই। অথচ আপনি গৌহাটি নেমে হয়তো ট্রেনে যাবেন লামডিং, সেখানে উঠবেন ডাকবাঙলোয়। বিছানা– বিশেষ করে মশারি– বিন কী করে গোয়াবেন দিন-রাতিয়া?
বিছানাটা নিলেন কি না। তার ভেতরে যে ভারী জিনিস কিছু কিছু লুকোবেন ভেবেছিলেন সেটি তা হলে হল না। অবশ্য লুকিয়ে কোনও লাভ হত না। কারণ জিনিসটিকে ওজন তো করা হতই– মালে আপনি ফাঁকি দিতে পারতেন না।
অ্যার ট্রাভেল করবেন মাত্র বিয়াল্লিশ পৌন্ড ফ্রি লগেজ– অতএব আপনি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের মতো একটি পিচবোর্ডে কিংবা ফাইবারের সুটকেসে মালপত্র পুরে– সেটার অবস্থা কী হবে মোকামে পৌঁছলে পর বলব– রওনা দিলেন অ্যার আপিসের দিকে, ছাতা-বরসাতি এটাচি হাতে, তার জন্য ফালতো ভাড়া দিতে হবে না (থ্যাঙ্ক ইউ!)। ট্যাক্সি যখন নিতেই হবে তখন সঙ্গে চললেন দু-একজন বন্ধু-বান্ধব। যদিস্যাৎ দৈবাৎ প্লেন মিস করেন তবে একটি কড়িও ফেরত পাবেন না বলে দু-দশ মিনিট আগেই রওনা দিলেন এবং অ্যার আপিসে পৌঁছুলেন পাকি সোয়া দু ঘন্টা পূর্বে আমার জাত-ভাই বাঙালিরা যেরকম ইসৃটিশানে গাড়ি ছাড়ার তিন ঘন্টা পূর্বে যায়।
অ্যার আপিসের লোক হন্তদন্ত হয়ে ট্যাক্সি থেকে আপনার মাল নামাবে। সে লোকটা কুলি-চাপরাসির সময় তা হোতূ গে, কিন্তু তার বাই সে হিন্দিতে রাষ্ট্রভাষাতে অর্থাৎ তার অউন, অরিজিন্যাল হিন্দিতে কথা বলবেই– যেরকম তার বসের ইংরেজি বলার বাই, অথচ উভয় পক্ষই বাঙালি। আমাদের বঙ্কিম, আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলতে আমরা অজ্ঞান, কিন্তু এই বাঙালা দেশের মহানগরী রামমোহন-রবীন্দ্রনাথের লীলাভূমিতেই আপিস-আদালত, রাস্তা-ঘাটে আ মরি বাংলা ভাষার কী কদর, কী সোহাগ।
.
০২.
কলকাতা বাঙালির শহর। বাঙালি বলতে আপনি-আমি মধ্যবিত্ত বাঙালিই বুঝি, তাই আমাদের আর আপিসগুলোর অবস্থা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মতো। অর্থাৎ মাসের পয়লা তিন দিন ইলিশ-মুরগি তার পর আলুভাতে আর মসুর ডাল।
ঢাক-ঢোল শাক-করতাল বাজিয়ে যখন প্রথম আমাদের অ্যার আপিসগুলো খোলা হয় তখন সেগুলো বানানো হয়েছিল একদম সায়েবি কায়দায়। বড় বড় কৌচ, বিরাট বিরাট সোফা, এন্তার ফ্যান, হ্যাট-স্ট্যান্ড, গ্লাস-টপ টেবিল, তার উপরে থাকত মাসিক, দৈনিক, অ্যাশট্রে আরও কত কী। সাহস হত না বসতে, পাছে জামাকাপড়ের ঘষায় সোফার চামড়া নোংরা হয়ে যায়– চাপরাসিগুলোর উর্দিই তো আমার পোশাকের চেয়ে ঢের বেশি দুরস্ত, ছিমছাম।
আর আজ? চেয়ারগুলোর উপর যা ময়লা জমেছে তাতে বসতে ঘেন্না করে। ফ্যানগুলো ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ছুটির আবেদন জানাচ্ছে, দেওয়ালে চুনকাম করা হয়নি সেই অন্নপ্রাশনের দিন থেকে সমস্তটা নোংরা, এলোপাতাড়ি আর আবহাওয়াটা ইংরেজিতে যাকে বলে ডেয়ারি, ডিসম।
একটা অ্যার আপিসে দেখেছি ভিতরে যাবার দরজায় যেখানে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে হয় সেখানে যা ময়লা জমেছে তার তুলনায় রান্নাঘরের তেলচিটে কালি-মাখা দরজাও পরিষ্কার। আপনি সহজে বিশ্বাস করবেন না, আসুন একদিন আমার সঙ্গে, আপনাকে দেখিয়ে দেব।
এইবারে একটু আনন্দের সন্ধান পাবেন। দশাশয়ী লাশদের যখন ওজন করা হবে তখন আড়নয়নে ওজনের কাঁটাটার দিকে নজর রাখবেন। ১৬০ থেকে তামাসা আরম্ভ হয়, তার পর ডবল সেরি পেরিয়ে কেউ কেউ মুশতাক আলীর মতো ট্রিপলের কাছাকাছি পৌঁছে যান। আমার বন্ধু — মুখুয্যে যখন একবার ওজন নিতে উঠেছিল তখন কাঁটাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে ঘুরতে শেষটায় থপ করে শূন্যে এসে ভিরমি গিয়েছিল। মুখুয্যে আমাকে হেসে বলেছিল, কিন্তু ভাড়া তুমি যা দাও আমিও তাই।
কী অন্যায়।
তার পর আবার সেই একটানা একঘেয়ে অপেক্ষা।
তিন কোয়ার্টার পরে খবর আসবে– মালপত্র সব বাসে তোলা হয়ে গিয়েছে। আপনারা গা তুলুন।
রবিঠাকুর কী একটা গান রচেছেন না?
আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে
তোমার সুরের সুরে সুর মেলাতে
অ্যার কোম্পানির বাসগুলো কিন্তু আপিসগুলোর সঙ্গে দিব্য সুর মিলিয়ে বসে আছে। লড়াইয়ের বাজারে যখন বিলেত থেকে নতুন মোটর আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন কচু-বন থেকে কুড়িয়ে-আনা যেসব বাস গ্রামাঞ্চলে চড়েছিলুম আমাদের অ্যার কোম্পানির বাস প্রায় সেইরকম। ওদেরই আপিসের মতো নোংরা, নড়বড়ে আর সিটগুলোর স্প্রিং অনেকটা আরবিস্তানের উটের পিঠের মতো। ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন হওয়ার শখ যদি আপনার হয়, আরব দেশ না গিয়ে, তবে এই বাসের যে কোনও একটায় দু-দণ্ডের তরে চড়ে নিন। আপনার মনে আর কোনও খেদ থাকবে না।
মধ্য কলকাতা থেকে দমদম ক-মাইল রাস্তা সে খবর বের করা বোধহয় খুব কঠিন নয়; কিন্তু সেই বাসে চড়ে আপনার মনে হবে :
যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ।
মোটর, ট্যাক্সি, স্টেট বাস, বেসরকারি বাস এমনকি দু-চারখানা সাইকেল-রিকশাও আপনাকে পেরিয়ে চলে যাবে। ত্রিশ না চল্লিশ জন যাত্রীকে এক খেপে দমদম নিয়ে যাবার জন্য তৈরি এই ঢাউস বাস–প্রতি পদে সে জাম্ হয়ে যায়, ড্রাইভার করবে কী, আপনিই-বা বলবেন কী?