এতক্ষণ ধরে যে ঐতিহ্যের বর্ণনা দিলুম সে শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রভু খ্রিষ্ট সাধু এবং পণ্ডিতি ভাষা হিব্রুতে তার ধর্ম প্রচার করেননি। তাঁর প্রথম ও প্রধান শিষ্যদের বেশিরভাগই ছিলেন অতি সাধারণ জেলে। তার প্রচারকার্য এঁদের নিয়েই আরম্ভ হয় বলে তিনি তার বাণী প্রচার করেছিলেন গ্যালিলি-নাজারেৎ অঞ্চলবোধ্য আরামেইক উপভাষায়। মহাপুরুষ মুহম্মদও যখন আরবির মাধ্যমে আল্লার আদেশ প্রচার করলেন তখন আরবি ভাষা ছিল পৌত্তলিকদের না-পাক ভাষা, এবং সে ভাষায় ধর্মপ্রচারের কোনও ঐতিহ্য ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে লেখা আছে মহাপুরুষ মুহম্মদের ঈষৎ পূর্বে এবং তার সমবর্তীকালে মক্কাবাসীদের যারা সত্য পথের অনুসন্ধান করতেন তারা হিব্রু শিখে সে ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়তেন। তাই যখন মহাপুরুষ হিব্রুর শরণাপন্ন না হয়ে আরবির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার করলেন তখন সবাই তাজ্জব মেনে গেল। তার উত্তরে আল্লা-ই কুরান শরিফে বলেছেন, তার প্রেরিত পুরুষ যদি আরব হয় তবে প্রচারের ভাষা আরবি হবে না তো কী হবে? আর আরবি না হলে সবাই বলত, আমরা তো এসব বুঝতে পারছিনে।
লুথারও পোপের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন জর্মনের পক্ষ নিয়ে পণ্ডিতি লাতিন তিনি এই বলেই অস্বীকার করেছিলেন যে, সে ভাষার সঙ্গে আপামর জনসাধারণের কোনও যোগসূত্র ছিল না।
মোদ্দা কথা এই, এ পৃথিবীতে যতসব বিরাট আন্দোলন হয়ে গিয়েছে তা সে নিছক ধর্মান্দোলনই হোক আর ধর্মের মুখোশ পরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনই হোক তার সব কটাই গণ-আন্দোলন এবং গণ-আন্দোলন সর্বদাই আঞ্চলিক গণভাষার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করেছে।*[* রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে-বিপক্ষে যে কটি যুক্তি আছে, সবকটিরই আলোচনা করা এ প্রবন্ধমালার উদ্দেশ্য– লেখক।]
.
০২.
রাষ্ট্রভাষার যে প্রয়োজন আছে সে সত্য তর্কাতীত, কিন্তু প্রশ্ন সে ভাষা গণ-আন্দোলন উদ্বুদ্ধ করতে পারবে কি না? যারা মনে করেন, স্বরাজ লাভ হয়ে গিয়েছে এখন আর গণ-আন্দোলনের কোনও প্রয়োজন নেই, তারা হয় মারাত্মক ভুল করছেন, নয় ভাবছেন দেশের জনগণ তাদের জন্য পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে খাটবে আর তারা শহরে শহরে দিব্য খাবেন-দাবেন আর কেউ কোনওপ্রকারের তেরিমেরি করলে ডাণ্ডা উঁচিয়ে ভয় দেখাবেন এবং তাইতেই সবকিছু বিলকুল ঠাণ্ডা হয়ে থাকবে।
সেটি হচ্ছে না, সেটি হবার জো নেই। যে জনসাধারণকে একদা স্বাধীনতা সম্বন্ধে সচেতন করে স্বরাজের জন্য লড়ানো হল, তাদের এখন ডেকে আনতে হবে রাষ্ট্রনির্মাণ কর্মে। তারা যদি ভারতীয় রাষ্ট্রকে আপন রাষ্ট্র বলে চিনতে না পারে, সে রাষ্ট্রের প্রতি যদি তাদের আত্মীয়তাবোধ না জন্মে তবে নানাপ্রকারের বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তার ফিরিস্তি দেবার প্রয়োজন নেই। পাড়ার কম্যুনিস্টকে ডেকে জিগ্যেস করুন– সে সব বাৎলে দেবে।
এখন প্রশ্ন, কোন ভাষার মাধ্যমে আমরা জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হব? বেশিরভাগ লোকই স্বীকার করে নিয়েছেন পাঠশালাতে মাত্র একটি ভাষা শেখানো হবে। অর্থাৎ হিন্দি যেসব অঞ্চলের আপন ভাষা সেগুলো বাদ দিয়ে আর সর্বত্র মাত্র প্রাদেশিক ভাষাটিই শেখানো হবে। অর্থাৎ বাঙলা, উড়িষ্যা, অন্ধ্র অঞ্চলের পাঠশালাগুলোতে ছেলেমেয়েরা সুদ্ধ আপন আপন মাতৃভাষা শিখবে। ভারতবর্ষ থেকে নিরক্ষরতা কবে দূর হবে জানিনে, তবে আশা করি সকলেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, নিরক্ষরতা দূর হওয়ার বহু বৎসর পর পর্যন্ত এদেশের শতকরা ৭০টি ছেলেমেয়ে পাঠশালাতেই লেখাপড়া শেষ করবে এবং শিখবে শুধু মাতৃভাষা।
বাদবাকিরা হিন্দি শিখবেন– সে হিন্দি জ্ঞান কতটা হবে তার আলোচনা পরে হবে এবং ক্রমে ক্রমে অতি অল্পসংখ্যক লোকই ইংরেজি শিখবেন, আজকের দিনে চীন কিংবা মিশরের লোক যে অনুপাতে ইংরেজি শেখে।
রাষ্ট্রভাষা সর্বভারতে চালু করনেওয়ালারা বলেন, আজ ইংরেজি ভাষা যেরকম ব্যবহৃত হচ্ছে একদিন হিন্দি তার আসনটি নিয়ে নেবে অর্থাৎ যাবতীয় রাজকার্য, মামলা-মোকদ্দমার তর্কাতর্কি, রায়, আপিল, বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য, পার্লিমেন্টে বক্তৃতা ঝাড়া ইত্যাদি তাবৎ কর্ম হিন্দিতে হবে। কলকাতা তথা অন্ধ, তামিলনাড়ু বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দির মাধ্যমে জ্ঞানদান হবে কি না সে সম্বন্ধে অনেকেরই মনে ধোকা রয়ে গিয়েছে, তবে কট্টর রাষ্ট্রভাষীদের বাসনা যে তাই সে সম্বন্ধে খুব বেশি সন্দেহ নেই।
তা হলে অনায়াসে ধরে নিতে পারি ইংরেজ আমলে যেরকম আমাদের বেশিরভাগ ভালো লেখকেরা সভ্যতা সংস্কৃতি সম্বন্ধে ইংরেজিতে বই লিখতেন (রাধাকৃষ্ণনের ইন্ডিয়ান ফিলসফি থেকে পণ্ডিতজির ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ইন্তেক) ঠিক তেমন আমাদের ভবিষ্যতের শক্তিশালী লেখকেরা তাদের প্রচেষ্টা নিয়োগ করবেন হিন্দির মাধ্যমে এবং যে সৎসাহিত্য গল্প উপন্যাস কবিতাই সাহিত্যের একমাত্র কিংবা প্রধান সৃষ্টি নয়– হিন্দিতে গড়ে উঠবে সেটা, বাঙলা, তামিল, গুজরাতি সাহিত্য-সৃষ্টিপ্রচেষ্টার খেসারতি দিয়ে। এতদিন যে ভারতীয় ভাষাগুলোতে নানামুখী সৃষ্টিকার্য প্রসার এবং প্রচার লাভ করতে পারছিল না তার জন্য আমরা প্রাণভরে ইংরেজির জগদ্দল পাথরকে গালমন্দ করেছি এখন হিন্দির চাপে সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, কিন্তু হয়তো গালমন্দ করার অধিকার থাকবে না। পূর্ববঙ্গে যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালু করবার চেষ্টা হয়েছিল তখন আমি অন্যান্য যুক্তির ভিতর এইটিও পেশ করে তীব্রকণ্ঠে আপত্তি জানিয়েছিলুম এবং বহু পূর্ববঙ্গবাসী আমার যুক্তিতে সায় দিয়েছিলেন।