প্রবাসীর কথা (এবং সুদ্ধমাত্র যেকথা লিখতে গেলেই পুরোপুরি একখানি ভুলুম লিখতে হয়; আমার মনে হয় প্রবাসীর কর্মকর্তারা যদি প্রবাসী সঞ্চয়ন জাতীয় একটি ভলম বের করেন তবে বড় ভালো হয় এতে থাকবে প্রবাসী থেকে বাছাই বাছাই জিনিস) বাদ দিলেই আসে মডার্ন রিভুর কথা। তখনকার দিনে মডার্ন রিভ খাস লন্ডনে প্রচারিত যে কোনও কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। আজও প্রাচ্যভূমিতে এরচেয়ে সেরা ইংরেজি মাসিক বেরোয়নি।
প্রবাসী ও মডার্ন রিভ্যু (বিশাল ভারতের সঙ্গে আমি পরিচিত নই; পণ্ডিত হাজারীপ্রসাদ নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে হিন্দির পৃষ্ঠপোষক রামানন্দ- লিখবেন) এই একাধিক পত্রিকার মাধ্যমে রামানন্দ ভারতের রাজনৈতিক চিন্তায় এনে দেন স্পষ্ট চিন্তন, স্পষ্ট ভাষণ ও সর্বোপরি নির্ভীকতম সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার প্রচার। আমার মতো বহু মুসলমান তখন রামানন্দকে চিন্তার জগতে নেতা বলে মেনে নিয়েছিলেন।
তার পর এমন একদিন এল যখন তাকে অনুসরণ করা আমার পক্ষে আর সম্ভবপর হল না। কিন্তু একশোবার বলব, তিনি তার বিবেকবুদ্ধিতে যেটি সত্য পথ বলে ধরে নিয়েছিলেন সেই পথেই এগোলেন। কোনও সস্তা রাজনীতির চাল তাতে এক কানাকড়িও ছিল না।
বিশ্বভারতীতে আমি ছাত্র থাকার সময় পরম শ্রদ্ধেয় স্বৰ্গত রামানন্দ কিছুদিনের জন্য অধ্যক্ষ ছিলেন। সে-সময়ে তার সাক্ষাৎ শিষ্য না হলেও তার সংস্পর্শে এসে ধন্য হয়েছি। অন্য সব কথা বাদ দিন, আমাকে স্তম্ভিত করেছিল তার চরিত্রবল। এবং সঙ্গে সাতিশয় মৃদুকণ্ঠে কঠোরতম, অকুণ্ঠ সত্যপ্রচার।
***
এদেশে এরকম একটি লোক আজ চাই। কর্তাদের কানে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য।
***
ওঁ শান্তিঃ, শান্তি, শান্তিঃ।
———–
১. বহু শিরোনামটি আমার মনে নেই বলে দুঃখিত।
রাষ্ট্রভাষা
০১.
ভারতবর্ষের সবাই যদি এক ভাষায় কথা বলত তা হলে সবদিক দিয়ে আমাদের যে কত সুবিধে হত সেকথা ফলিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। শুধু যে কাজ-কারবারের মেলা বখেড়ার ফৈসালা হয়ে যেত তাই নয়, একই ভাষার ভিত্তিতে আমরা অনায়াসে নবীন ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের ইমারত গড়ে তুলতে পারতুম। মালমসলা আমাদের বিস্তর রয়েছে, তাই সে ইমারত বাইরের পাঁচটি দেশের শাবাসিও পেত।
এ তত্ত্বটা নতুন নয়। কিন্তু একই ভাষার ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক ইমারত গড়ে তুলতে গেলেই এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে করজোড়ে স্বীকার করছি আমার জীবনে আমি যত দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কাবু করেছে– এ দ্বন্দ্বের সমাধান আমি কিছুতেই করে উঠতে পারিনি। বিচক্ষণ পাঠক যদি দয়া করে এ অধমকে সাহায্য করেন।
বৈদিক সভ্যতাসংস্কৃতি একটিমাত্র ভাষার ওপরই খাড়া ছিল সেকথা আমরা জানি তার কারণ সে যুগে আর্যরা ভারতবর্ষে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়েননি এবং দ্বিতীয়তর অনার্যদের সঙ্গে তাঁদের ব্যাপক যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি বলে সে ভাষাতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন অতি অল্পই হয়েছিল।
প্রভূ বুদ্ধের যুগ আসতে না আসতেই দেখি, সে ভাষা আর আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারছে না। যতদূর জানা আছে, প্রভু বুদ্ধ তার নবীন ধর্ম প্রচারের জন্য বৈদিক ভাষা কিংবা সে ভাষার তকালীন প্রচলিত রূপের শরণ নেননি। তিনি তৎকালীন সর্বজনবোধ্য ভাষার শরণ নিয়েছিলেন সে ভাষাকে প্রাকৃত বলা যেতে পারে। ব্রাহ্মণ্যধর্ম কিংবা ব্রাহ্মণ্য ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত তিনি যে বিহারে প্রচলিত তকালীন সর্বজনবোধ্য ভাষার স্মরণ নিয়েছিলেন তা নয়, কারণ সকলেই জানেন বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ-শ্ৰমণ এই সমাস বার বার ব্যবহার করেছেন, উভয়কে সমান সম্মান দেখাবার জন্য। জনপদ-ভাষা যে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার একমাত্র কারণ বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষের অন্যতম সর্বপ্রথম গণ-আন্দোলন এবং গণ-ভাষার প্রয়োগ ব্যতীত গণ-আন্দোলন সফল হতে পারে না।
এস্থলে লক্ষ করবার বিষয় বিহারের আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহার করতে বুদ্ধদেব সর্বভারতের পণ্ডিতজনবোধ্য ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনি তাতে বিচলিত হননি।
ঠিক একই কারণে মহাবীর জিনও আঞ্চলিক উপভাষার শরণ নিয়ে অর্ধ-মাগধীতে আপন বাণী প্রচার করেন। শাস্ত্রীয় মতবাদ এবং জীবহত্যা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ মতানৈক্য বাদ দিলে বৌদ্ধ ও জৈন গণ-আন্দোলন একই রূপ একই গতি ধারণ করেছিল।
অশোকস্তম্ভে উত্তীর্ণ ভাষাও সংস্কৃত নয়।
তার পরের বড় আন্দোলন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব আনয়ন করেন। তিনিও প্রধানত সর্বজনবোধ্য বাঙলার শরণ নিয়েছিলেন–যদিও তার সংস্কৃতজ্ঞান সে যুগের কোনও পণ্ডিতের চেয়ে কম ছিল না। পশ্চিম ও উত্তর ভারতেও তুকারাম মারাঠি ব্যবহার করেন। কবীর-দাদু। প্রভৃতি সাধকেরা হিন্দি ব্যবহার করেন। কবীর বললেন, সংস্কৃত কূপজল, সে জল কুয়ো থেকে বের করে আনতে হলে ব্যাকরণ-অলঙ্কারের লম্বা দড়ির প্রয়োজন কিন্তু ভাষা (অর্থাৎ সর্বজনবোধ্য প্রচলিত ভাষা) বহতা নীর–সে জল বয়ে যাচ্ছে, যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে শরীর শান্ত করা যায়। আর তুকারাম বললেন, সংস্কৃত যদি দেবভাষা হয় তবে মারাঠি কি চোরের ভাষা?
তার পরের গণ-আন্দোলন মহাত্মা গান্ধী আরম্ভ করেন। তিনি যদিও জনগণের ভাষা হিন্দির শরণ নিয়েছিলেন তবু লক্ষ করার বিষয় যে, অসহযোগ আন্দোলন বাঙলা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কেরালায় হিন্দি কিংবা ইংরেজির মাধ্যমে আপামর জনসাধারণে প্রসারলাভ করেনি; জনগণ যে সাড়া দিল সে বাঙলা, তামিল, তেলুগু, মালয়ালাম ভাষার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন প্রচার করার ফলে। বারদলই সত্যাগ্রহের প্রধান বক্তা ছিলেন বল্লভভাই পটেল। তিনি যে অদ্ভুত তেজস্বিনী গুজরাতি ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে ভাষা অনায়াসে সাহিত্যের পর্যায়ে ওঠে। বল্লভভাইয়ের গুজরাতির সঙ্গে তার হিন্দির কোনও তুলনাই হয় না।