তার পর ১৯৪৮ থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের বহু জায়গায় প্লেনে গিয়েছি এবং যাচ্ছি। একদিন হয়তো পুষ্পক-রথে করেই স্বর্গে যাব, অর্থাৎ প্লেন-ক্রাশে অক্কালাভ কর তাতে আমি আশ্চর্য হব না, কারণ এ তো জানা কথা, ডানপিটের মরণ গাছের আগায়। সেকথা থাক।
কিন্তু আশ্চর্য হয়ে প্রতিবারেই লক্ষ করি, পঁচিশ বৎসর পূর্বে প্লেনে যে সুখ-সুবিধে ছিল আজও প্রায় তাই। ভুল বলা হয়, সুখ-সুবিধে না বলে অসুখ-অসুবিধে বলাই উচিত ছিল। কারণ প্লেনে সফর করার মতো পীড়াদায়ক এবং বর্বরতম পদ্ধতি মানুষ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি। আমার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যেসব হতভাগ্য প্লেনে চড়েন তারা ওকিব-হাল, তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। উপস্থিত তাই তাঁদেরই উদ্দেশে নিবেদন, প্লেনে চড়ার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যাদের এ যাবৎ হয়নি।
রেলে কোথাও যেতে হলে আপনি চলে যান সোজা হাওড়া। সেখানে টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসেন-ব্যস হয়ে গেল। অবশ্য আপনি যদি বার্থ রিজার্ভ করতে চান তবে অন্য কথা, কিন্তু তবু একথা বলব, হঠাৎ খেয়াল হলে আপনি শেষ মুহূর্তেও হাওড়া গিয়ে টিকিট এবং বার্থের জন্য একটা চেষ্টা দিতে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত কোনওগতিকে একটা বার্থ কিংবা নিদেনপক্ষে একটা সিট জুটে যায়ই।
প্লেনে সেটি হবার যো নেই। আপনাকে তিন দিন, পাঁচ দিন, কিংবা সাত দিন পূর্বে যেতে হবে অ্যার আপিসে। এক হাওড়া স্টেশন থেকে আপনি বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি, গৌহাটি– এমনকি ব্যান্ডেল-হুঁগলী হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত যেতে পারেন কিন্তু একই অ্যার আপিস আপনাকে সব জায়গার টিকিট দেয় না কেউ দেবে ঢাকা আর আসাম, কেউ দেবে মাদ্রাজ অঞ্চল, কেউ দেবে দিল্লির।
এবং এসব অ্যার আপিস ছড়ানো রয়েছে বিরাট কলকাতার নানা কোণে, নানা গহ্বরে। এবং বেশিরভাগই ট্রামলাইন, বাসলাইনের উপরে নয়। হাওড়া যান ট্রামে, দিব্য মা গঙ্গার হাওয়া খেয়ে, অ্যার আপিসে যেতে হলে প্রথমেই ট্যাক্সির ধাক্কা।
আর আপিসে ঢুকেই আপনার মনে হবে ভুল করে বুঝি জঙ্গি দফতরে এসে পড়েছেন। পাইলট, রেডিও অফিসার তো উর্দি পরে আছেনই- এমনকি টিকিটবাবু পর্যন্ত শার্টের ঘাড়ে লাগিয়েছেন নীল-সোনালির ব্যাজ-বিল্লা-রিবন-পট্টি– যা খুশি বলতে পারেন। রেলের মাস্টারবাবু, গার্ড সাহেবরা উর্দি পরেন কিন্তু সে উর্দি জঙ্গি কিংবা লস্করি উর্দি থেকে স্বতন্ত্র– অ্যার আপিসে কিন্তু এমনই উর্দি পরা হয়। খুব সম্ভব ইচ্ছে করেই যে আমার মতো কুনো বাঙালি সেটাকে মিলিটারি কিংবা নেভির য়ুনিফর্মের সঙ্গে গুবলেট পাকিয়ে আপন অজানাতে দুম্ করে একটা সলুট মেরে ফেলে।
তার পর সেই উর্দি পরা ভদ্রলোকটি আপনার সঙ্গে কথা কইবেন ইংরেজিতে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, আপনি ধুতি-কুর্তা-পরা নিরীহ বাঙালি তবু ইংরেজি বলা চাই। আপনি না হয় সামলে নিলেন বিএ, এমএ পাস করেছেন কিন্তু আমি মশাই, পড়ি মহা বিপদে। তিনি আমার ইংরেজি বোঝেন না, আমি তার ইংরেজি বুঝতে পারিনে– কী জ্বালা! এখন অবশ্য অনেক পোড় খাওয়ার পর শিখে গিয়েছি যে, জোর করে বাঙলা চালানোই প্রশস্ততম পন্থা! অন্তত তিনি আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারেন।
তখখুনি যদি রোক্কা টাকা ঢেলে দিয়ে টিকিট কাটেন তবে তো ল্যাঠা চুকে গেল কিন্তু যদি শুধু বুক করান তবে আপনাকে আবার আসতে হবে টাকা দিতে। নগদ টাকা ঢেলে দেওয়াতে অসুবিধে এই যে, পরে যদি মন বদলান তবে রিফান্ড পেতে অনেক হ্যাপা পোয়াতে হয়। সে না হয় হল, রেলের বেলাও হয়।
কিন্তু প্লেনের বেলা আরেকটা বিদকুটে নিয়ম আছে। মনে করুন আপনি ঠিক সময় দমদমা উপস্থিত না হতে পারায় প্লেন মিস করলেন। রেলের বেলা আপনি তখুনি টিকিট ফেরত দিলে শতকরা দশ টাকা কিংবা তারও কম কম-বেশি খেসারতির আক্কেলসেলামি দিয়ে ভাড়ার পয়সা ফেরত পাবেন। প্লেনের বেলা সেটি হচ্ছে না। অথচ আপনি পাকা খবর পেলেন, প্লেনে আপনার সিট ফাঁকা যায়নি, আরেক বিপদগ্রস্ত ভদ্রলোক পুরো ভাড়া দিয়ে আপনার সিটে করে ট্রাভেল করেছেন, অ্যার কোম্পানিও স্বীকার করল কিন্তু আপনি একটি কড়িও ফেরত পাবেন না। অ্যার কোম্পানির ডবল লাভ! এ নিয়ে দেওয়ানি মোকদ্দমা লাগালে কী হবে বলতে পারি নে, কারণ আমি আদালতকে ডরাই আর কোম্পানির চেয়ে একটুখানি বেশি।
টিকিট কেটে তো বাড়ি ফিরলেন। তার পর সেই মহামূল্যবান মূল্যপত্রিকাখানি পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে প্লেন দমদমা থেকে ছাড়বে দশটার সময়, আপনাকে কিন্তু অ্যার আপিসে হাজিরা দিতে হবে আটটার সময়! রলে কী? নিতান্ত থাডো কেলাসে যেতে হলেও তো আমরা একঘণ্টার পূর্বে হাওড়া যাইনে–কাছাকাছির সফর হলে তো আধঘণ্টা পূর্বে গেলেই যথেষ্ট আর যদি ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ডের (প্লেনে আপনি ভাড়া দিচ্ছেন ফার্স্টের চেয়েও বেশি অনেক সময় ফার্স্টের দেড়া!) বার্থ রিজার্ভ থাকে তবে তো আধ মিনিট পূর্বে পৌঁছলেই হয়। আপনি হয়তো প্লেনে থাকবেন পৌনে দু ঘন্টা, অথচ আপনাকে অ্যার আপিসে যেতে হচ্ছে পাকি দু ঘন্টা পূর্বে (মোকামে পৌঁছে সেখানে আরও কত সময় যাবে সেকথা পরে হবে)।
এইবার মাল নিয়ে শিরঃপীড়া। আপনি চুয়াল্লিশ (কিংবা বিয়াল্লিশ) পৌন্ড লগেজ ফ্রি পাবেন। অতএব,