হিটলার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করেছিলেন মার্কিন এবং ইংরেজ একদিন না একদিন অতি অবশ্য বুঝতে পারবে, ওদের শত্রু জৰ্মনি নয়, ওদের আসল শত্রু রুশ। এবং সেইটে হৃদয়ঙ্গম করামাত্রই তারা জর্মনির সঙ্গে আলাদা সন্ধি করে সবাই একজোট হয়ে লড়াই দেবে রুশের বিরুদ্ধে। হিটলার আশা করেছিলেন, যেদিন মার্কিনিংরেজ জর্মনির কিয়দংশ দখল করার পর রুশের মুখোমুখি হবে সেইদিনই লেগে যাবে ঝগড়া, মার্কিনিংরেজ স্পষ্ট বুঝতে পারবে, রুশ কী চিজ এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু ঠিক সেইটেই হল না। বার্লিনকে বাইপাস করে রুশ এবং মার্কিনিংরেজ যখন মুখোমুখি হল তখন তারা সুবোধ বালকের ন্যায় আপন আপন গোঠে জমিয়ে বসে গেল।
এবং অদৃষ্ট হিটলারের দিকে শেষ মুহূর্তে কী নিদারুণ মুখ-ভেংচিই-না কেটে গেলেন।
হিটলারের দুর্দশা যখন চরমে, তিনি যখন দিবারাত্রি আকস্মিক ভাগ্য-পরিবর্তনের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছেন, গ্যোবেলস্ প্রজ্ঞ হৃদয়ে সাহস সঞ্চারের এবং কালাইলের লিখিত ফ্রেরিক দি গ্রেটের ইতিহাস মাঝে মাঝে পড়ে শুনিয়ে যান, এমন সময় উত্তেজনায় বিবশ গ্যোবেলস্ প্রভুকে ফোন করলেন, মাইন ফুরার, আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। নিয়তি আপনার পরম শত্রুকে বিনাশ করেছেন। জারিনা মারা গেছেন।
এস্থলে জারিনা অবশ্য রোজোভেল্ট, তিনি মারা যান ১২ এপ্রিল ১৯৪৫।
কিন্তু হায়, চার্চিল নয়, অদৃশ্য হলেন রোজোভেল্ট! তবু মন্দের ভালো। কিন্তু তার চেয়েও নিদারুণ— হায়, হায় রোজোভেল্টের মৃত্যু সত্ত্বেও মার্কিন তার সমরনীতি বদলাল না। হিটলার প্রতিটি মুহূর্ত গুনলেন অধীর প্রত্যাশায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে। আত্মহত্যা করলেন তার আঠারো দিন পরে। ফ্রেডরিককে করতে হয়নি।
***
এইবারে তাঁর শেষ ভবিষ্যদ্বাণী :
জর্মনি হেরে গেলে, যতদিন না এশিয়া, আফ্রিকা এবং সম্ভবত দক্ষিণ আমেরিকার ন্যাশনালিজমগুলো জাগ্রত হয়, ততদিন পৃথিবীতে থাকবে মাত্র দুটি শক্তি যারা একে অন্যকে মোকাবেলা করতে পারে মার্কিন এবং রুশ। ভূগোল এবং ইতিহাসের আইন এদের বাধ্য করবে একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সশস্ত্র সংগ্রাম কিংবা অর্থনীতি এবং আদর্শবাদের (ইডিয়লজিকাল) সংগ্রাম। এবং সেই ইতিহাস ভূগোলের আইনেই উভয়পক্ষই হবে ইউরোপের শত্রু। এবং এ বিষয়েও কণামাত্র সন্দেহ নেই যে, শীঘ্রই হোক আর দেরিতেই হোক, উভয়পক্ষকেই ইয়োরোপের একমাত্র বিদ্যমান শক্তিশালী জর্মন জাতির বন্ধুত্বের জন্য হাত পাততে হবে।
এর টীকা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড় যে জর্মনিতেই হচ্ছে সেকথা কে-না জানে? আর আডেনাওয়ারের কণ্ঠস্বর যে ক্রমেই উঁচু পর্দায় উঠছে সে-ও তো শুনতে পারছি! এবং রুশ যে পূর্ব জর্মনির মারফতে পশ্চিম জর্মনির সঙ্গে আলাদা সন্ধি করতে উদগ্রীব, সে-ও তো জানা কথা।
————
১. একমাত্র জঙ্গিলাট কাইটেল করেছিলেন। ফ্রান্স পরাজয়ের খবর পৌঁছলে তিনি উল্লাসে বে-এক্তেয়ার হয়ে হিটলারকে উদ্দেশ করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বলেছিলেন, আপনি সর্বকালের সর্ব সেনাপতির প্রধানতম! Groesste Feldherr alle Zeiten/ ঈষৎ অবান্তর হলেও এস্থলে বলি, হিটলার যখন রুশে পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছেন তখন জর্মন কাষ্ঠরসিকরা Groesste-এর Gro, Feldher-এর E, aller-এর A এবং Zeiten-এর 2 নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে Grofatz নির্মাণ করেন। এখানে Gro মানে বিরাট এবং Fatz শব্দের অর্থ– গ্রাম্য ভাষায় বাতকর্ম। আমি বাংলায় ভদ্ৰশব্দটি প্রয়োগ করলুম। বাংলা আটপৌরে শব্দটির সঙ্গে জর্মন শব্দটির উচ্চারণের মিল এস্থলে লক্ষণীয়।
২. যেমন মনে করুন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কানুন ছিল, শত্ৰু পরাজিত হলেও এক দিনের ভেতর কুড়ি মাইলের বেশি এগোবে না, পাছে তোমার লাইন অব কম্যুনিকেশন ছিন্ন হয়ে যায়। ব্লিস ক্ৰিগে পঞ্চাশ মাইলও নস্যি।
৩. মুসোলিনি বলেছেন, হিটলার প্রতিটি লড়াই লড়েছে আমাকে নোটিশ না দিয়ে আমিই-বা কেন আগেভাগে দিতে যাব?
৪. এরসঙ্গে তুলনীয় মার্কিন কর্তৃক হিরোশিমায় অ্যাটম বম প্রয়োগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জর্মনির পরাজয়ের পর জাপান নিরপেক্ষ সুইডেনের মারফতে আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায়। মার্কিন সেটা গ্রহণ করলে হিরোশিমায় অ্যাটম বম ফাটিয়ে তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। তাই করেনি। করল এক্সপেরিমেন্টটা দেখে নিয়ে।
মৃত্যু
বুড়ো হওয়াতে নাকি কোনও সুখ নেই।
আমি কিন্তু দেখলুম, একটা মস্ত সুবিধা তাতে আছে। কোনও কিছু একটা অপ্রিয় ঘটনা ঘটলে যেমন ধরুন প্রিয়-বিয়োগ–মনকে এই বলে চমৎকার সান্ত্বনা দেওয়া যায় যা এটার তিক্ত স্মৃতি আর বেশিদিন বয়ে বেড়াতে হবে না। মৃত্য তো আসন্ন। যৌবনে দাগা খেলে তার বেদনার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় সমস্ত জীবন ধরে। কিংবা, এই যে বললুম, প্রিয়-বিয়োগ– আমার যখন বয়স বছর চৌদ্দটা তখন আমার ছোট ভাই দু বছর বয়সে ওপারে চলে যায়। কালাজ্বরে। তার ছ মাস পরে ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন বেরোয়। তার পর যখন গণ্ডায় গণ্ডায় লোক তারই কল্যাণে কালাজ্বরের যমদূতগুলোকে ঠাস ঠাস করে দুগালে চড় কষিয়ে ড্যাং ড্যাং করে শহরময় চষে বেড়াতে লাগল তখন আমার শোক যেন আরও উথলে উঠল। বার বার মনে পড়তে লাগল, ওই চৌদ্দ বছর বয়সেই আমি তার জন্য কত না ডাক্তার, কবরেজ, বদ্যি, হেকিমের বাড়ি ধন্না দিয়েছিলুম। স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে যেতুম মায়ের কাছে শুধাতুম, আজ জ্বর এসেছিল? মা মুখটি মলিন করে ঘাড় ফিরিয়ে নিতেন। একটু পরে বলতেন, আজ আরও বেশি।