হায়, ইটালি যদি এ যুদ্ধে না নামত। তারা কোনও পক্ষে যদি যোগ না-দিত!
এ যুদ্ধ একা যদি জর্মনিই লড়ত– এ যদি অ্যাকসিসের যুদ্ধ না হত তবে আমি ১৫ মে, ১৯৪১-এ-ই রাশা আক্রমণ করতে পারতুম। জর্মন সৈন্য ইতোপূর্বে কোথাও পরাজিত হয়নি বলে আমরা শীত আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই (১৯৪১-৪২-এর শীত) যুদ্ধ খতম করে দিতে পারতুম। (ইটালির গ্রিস আক্রমণের ফলে ও তাকে সাহায্য করতে গিয়ে সময় নষ্ট হওয়াতে, হিটলার রাশা আক্রমণ করতে সমর্থ হলেন প্রায় এক মাস পরে। তিনি যখন মস্কোর কাছে এসে পৌঁছলেন তখন হঠাৎ প্রচণ্ড শীত আর বরফপাত আরম্ভ হল– এরকম ধারা শীত আর বরফ রাশাতেও বহুকাল ধরে পড়েনি যুদ্ধের তাবং যন্ত্রপাতির তেল-চর্বি জমে গেল, শীতের পূর্বেই জর্মন সৈন্য মস্কো দখল করে সেখানে শীতবস্ত্র লুট করতে পারবে বলে তারও কোনও ব্যবস্থা হিটলার করেননি, বহু হাজার সৈন্য শুধু শীতের অত্যাচারেই জমে গিয়ে মারা গেল। বলা যেতে পারে এই শীতেই হিটলারের পরাজয় আরম্ভ হল– যদিও সেটা দৃশ্যমান হল তার পরের শীতে স্টালিনগ্রাডে।}
হিটলার হা-হুতাশ করে বলেছেন, হায়, তাই সব-কিছু সম্পূর্ণ অন্য রূপ নিল!
কিন্তু প্রশ্ন, মস্কো দখল করতে পারলেই কি হিটলার শেষ পর্যন্ত জয়ী হতেন? নেপোলিয়ন তো মস্কো জয় করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তিনি রুশ জয় করতে পারেননি।
.
০২.
গত প্রবন্ধে মস্কো যুদ্ধের বর্ণনা লেখার কালি শুকোতে না শুকোতে খাস মস্কো থেকে একটি চমকপ্রদ খবর এসেছে। মস্কো যুদ্ধের বিংশ বাৎসরিক স্মরণ দিবসে গত ৫ ডিসেম্বর (১৯৬১ খ্রি.) মস্কো শহরে মার্শাল রকসস্কি তাস্ এজেন্সিকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জর্মনরা স্থির করেছিল, মস্কোকে জলের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে সেটাকে সমুদ্রের মতো করে ফেলবে। পরে যখন দেখা গেল টেকনিকাল কারণে সেটা সম্ভবপর নয়, তখন তারা বোমা ফেলে সেটা ধ্বংস করার চেষ্টা নিল।
আমার মনে হয়, টেকনিকাল কারণে সম্ভবপর হলেও কৃত্রিম বন্যায় মস্কো ভাসিয়ে দেবার প্রস্তাবে হিটলার স্বয়ং রাজি হতেন না। তার প্ল্যান ছিল, জর্মন সৈন্য মস্কো লুট করে গরম জামা-কাপড় এবং কিছু কিছু খোরাক পাবে কিন্তু প্রধানত গরম জামা-কাপড় ও শীতের আশ্রয়ই ছিল তার আসল লক্ষ্য, কারণ যুদ্ধ শীতের পূর্বেই শেষ হয়ে যাবে মনে করে হিটলার তার সৈন্যবাহিনীর জন্য সে ব্যবস্থা করেননি। (এস্থলে স্মরণ রাখা উচিত, জর্মনিতে কোনওকালেই উলের প্রাচুর্য ছিল না– জর্মনি চিরকালই তার জন্য নির্ভর করেছে। প্রধানত স্কটল্যান্ডের ওপর এবং মস্কোর দোরে যখন জর্মনরা আটকা পড়ে গেল তখন হিটলারকে বাধ্য হয়ে জর্মনির জনসাধারণের কাছে শীতবস্ত্রের জন্য ঢালাও আবেদন জানাতে হল)। কাজেই মস্কো শহরকে সমুদ্রে পরিণত করলে তার কোনও লাভই হত না। এবং মনে পড়ছে, নেপোলিয়নের বেলাতে রুশরা নিজেই কাঠের তৈরি মস্কো শহর পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার ফলে তিনি মস্কোর শ্মশানভূমিতে তাঁর সৈন্যের জন্য এককণা ক্ষুদ, ঘোড়ার জন্য একরত্তি দানা পাননি। এবারে রুশরা সেটা চাইলেও করতে পারত না, কারণ ইতোমধ্যে তারা মস্কো শহর কনক্রিট আর লোহাতে তার বাড়িঘর বানিয়ে বসে আছে। সেটাকে পোড়ানো অসম্ভব।
কাজেই মস্কো জয় করে নেপোলিয়ন লাভবান হননি, কিন্তু হিটলার হতেন।
মার্শাল রকসস্কি আরও বলেছেন, মস্কোবাসী এবং সেখানে রুশ সৈন্যদল জর্মনদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করা সত্ত্বেও তারা সেটা গ্রহণ করেননি। এটা সত্যই অত্যন্ত চমকপ্রদ খবর। এর একমাত্র কারণ এই হতে পারে যে, কোনও নগর আত্মসমর্পণ করলে সেটাকে বে-এক্তেয়ার লুটতরাজ করা যায় না।(৪)
অবশ্য যেসব ভুলের ফলে হিটলার মস্কো দখল করতে পারলেন না, সেগুলো না করে মস্কো দখল করতে পারলে তিনি যে তার পর অন্য ভুল করে যুদ্ধ হারতেন না, সেকথা বুক ঠুকে বলবে কে?
***
সমস্ত জৰ্মনি যখন রুশ, ইংরেজ, মার্কিন, ফরাসি সৈন্য দ্বারা অধিকৃত হয়ে গিয়েছে, রুশবাহিনী প্রায় তাবৎ বার্লিন দখল করে হিটলারের বুঙ্কারের থেকে দু-পাঁচ শগজ দূরে, বুঙ্কার সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, বার্লিনের বাইরে তার সৈন্যদল ও সেনাপতিরা আত্মসমর্পণে ব্যস্ত তখনও হিটলার কিসের আশায় পরাজয় স্বীকার করছিলেন না? আত্মহত্যার ঠিক তিন মাস পূর্বে হিটলার তার আদর্শ মানব ফ্রেডরিককে স্মরণ করে বলেছেন,
না। একেবারে আর কোনও আশা নেই, এরকম পরিস্থিতি কখনও আসে না। জর্মনির ইতিহাসে আকস্মিক কতবার তার সৌভাগ্যের সূচনা হয়েছে সেইটে শুধু একবার স্মরণ কর। সপ্তবর্ষীয় যুদ্ধে ফ্রেডরিক তার নৈরাশ্য ও দুরবস্থার এমনই চরমে পৌঁছেছিলেন যে, ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে তিনি মনস্থির করেন যে, বিশেষ একটি দিনের ভেতর তার সৌভাগ্যের সূত্রপাত না হলে তিনি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন। ওই স্থির করা বিশেষ দিনের মাত্র কয়েক দিন পূর্বে জারিনা হঠাৎ মারা গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন দৈবযোগে সমস্ত পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। মহান পুরুষ ফ্রেড়রিকের মতো আমরাও কয়েকটি সমবেত শক্তির (কোয়ালিশনের) বিরুদ্ধে লড়ছি, এবং মনে রেখ, কোনও কোয়ালিশনই চিরন্তনী সত্তা ধরে না। এর অস্তিত্ব শুধু গুটিকয়েক লোকের ইচ্ছার ওপর। আজ যদি হঠাৎ চার্চিল অবলুপ্ত হয়ে যায়, তা হলে তড়িৎশিখার ন্যায় এক মুহূর্তেই সমস্ত অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। ব্রিটেনের খানদানি মুরুব্বিরা সেই মুহূর্তেই দেখতে পাবে তারা কোন অতল গহ্বরের সামনে এসে পড়েছে এবং চৈতন্যোদয় হবে তখন।