কী দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম আর কোথায় এসে পড়েছি। কোথায় আফগানিস্তানের প্রস্তরময় শৈলশিখর আর কোথায় স্নেহভারে ডগমগ আরবের পাতালতল। এ সবকিছুর হিসেব-নিকেশ করে পররাষ্ট্রনীতির হদিস বানানো তো সোজা কর্ম নয়।
আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা এদেশের বিস্তর লোক আরবি এবং ফারসি উভয় ভাষাই জানেন। ইচ্ছে করলে এদের সম্বন্ধে আমরা নিজের মুখেই ঝাল খেতে পারি।
তাই বলি খোলো খোলা জানালা খোলো ॥*[** এ প্রবন্ধটি লিখি ১৩৫৬ (১৯৪৯ খ্রি.) সালে (অর্থাৎ দেশে-বিদেশে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হওয়ার সময়)। ইতোমধ্যে আরব ভূখণ্ডে রাজার বদলে কোনও কোনও জায়গায় ডিকটেটর হয়েছেন, মিশর থেকে ইংরেজ অনেক দূরে হটে গিয়েছে। নইলে এ প্রবন্ধের মূল দর্শন তখন যা ছিল, আজও তাই। আমি তাই প্রবন্ধের কোনও পরিবর্তন করিনি।]
মস্কো-যুদ্ধ ও হিটলারের পরাজয়
০১.
লজ্জায় জর্মন জাঁদরেলরা হিটলারকে মুখ দেখাতে পারতেন না। রুশ-যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বার বার সপ্রমাণ করে ছেড়েছিলেন যে, জাঁদরেলরা ভুল করছেন– সত্যপন্থা জানেন হিটলার।
ভের্সাইয়ের চুক্তিতে পরিষ্কার শর্ত ছিল জর্মনি রাইনল্যান্ডে সৈন্য সমাবেশ করতে পারবে না। হিটলার যখন করতে চাইলেন তখন জেনারেলরা তারস্বরে প্রতিবাদ করে বললেন, যদি তখন ফ্রান্স আমাদের আক্রমণ করে তবে…? হিটলার দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, করবে না। হিটলারের কথাই ফলল। অবশ্য হিটলার পরে একাধিকবার স্বীকার করেছেন, তখন ফ্রান্স আক্রমণ করলে জর্মনি নির্ঘাত হেরে যেত। তার পর হিটলার পরপর অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া গ্রাস করলেন– জেনারেলদের আপত্তি সত্ত্বেও ফরাসি-ইংরেজ রা-টি পর্যন্ত কাড়লে না। বার বার তিনবার লজ্জা পাওয়ার পরও পোল্যান্ড আক্রমণের পূর্বে জেনারেলরা ফের গড়িমসি করেছিলেন, এমনকি ফ্রান্স আক্রমণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও তারা ওই জুয়ো খেলতে চাননি। কিন্তু বার বার হিটলার প্রমাণ করলেন, জেনারেলদের আর যা থাকে থাক্ সমরনৈতিক দূরদৃষ্টি তাদের নেই ভবিষ্যদ্বাণী করা তো দূরের কথা।
এতবার লজ্জা পাওয়ার পর তারা আর কোন মুখ নিয়ে আপত্তি করতেন- হিটলার যখন রুশ আক্রমণ করবার প্রস্তাব তাদের সামনে পড়লেন এবং বহু বিদ্রি যামিনী যাপন করার পর যে হিটলার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন সেকথা তারা ভালো করেই জানতেন। বক্ষ্যমাণ টেস্টামেন্টেই আছে,
এ যুদ্ধে আমাকে যত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে তার মধ্যে কঠিনতম সিদ্ধান্ত রুশ আক্রমণ। আমি বরাবর বলৈ এসেছি, সর্বস্ব পণ করেও যেন আমরা দুই ফ্রন্টে লড়াই করাটা ঠেকিয়ে রাখি, এবং আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, আমি নেপোলিয়ন এবং তার রুশ-অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আপন মনে বহুদিন ধরে বিস্তর তোলাপাড়া করেছি।
এসব তত্ত্ব জানা থাকা সত্ত্বেও জেনারেলরা তো মানুষই বটেন। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের আকছারই যে আচরণ হয় তাদেরও তাই হয়েছিল। অর্থাৎ জর্মনি যখন পোল্যান্ড, গ্রিস, ফ্রান্স একটার পর একটা লড়াই জিতে চলল তখন জাদরেলরা নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়ে বললেন, আমরা জিতেছি, আমরা লড়াই জিতেছি। হিটলারকে স্মরণে আনবার প্রয়োজন তারা অনুভব করলেন না।(১) কিন্তু হিটলার রুশযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করলে পর এই আঁদরেলরাই মোটা মোটা কেতাব লিখলেন, হিটলার অগা, হিটলার বুদ্ধ– তারই দুর্বুদ্ধিতে আমরা লড়াই হারলুম। বাংলা প্রবাদে বলে, খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলা গোবন। ফ্রান্স জয়ের দই খেলেন জাদরেলরা, রুশ পরাজয়ের বিকার হল হিটলারের। অবশ্য তাঁর পক্ষে এই সান্তনা যে, তিনি এসব বই দেখে যাননি।
অবশ্য তিনিও কম না। জাদরেলরা যা করেছেন তিনিও তাই করে গেছেন। পোল্যান্ড ফ্রান্স জয়ের গর্ব তিনি করেছেন পুরো ১০০ নঃ পঃ, কিন্তু রুশ-অভিযান-নিষ্ফলতার জন্য দায়ী করেছেন তার জাদরেলদের ন-সিকে। তিনি আত্মহত্যা করবার কয়েক ঘন্টা পূর্বে যে উইল লিখে যান তাতে লিখেছেন, বিমানবাহিনী লড়েছে ভালো, নৌবহরও কিছু কম নয়, স্কুল-সৈনিকরাও লড়েছে উত্তম, কিন্তু সর্বনাশ করেছে ওই জাঁদরেলরা। অন্যত্র তিনি বলেছেন, তারা মূর্খ, তারা প্রগতিশীল নয়, যুদ্ধের সময় তাদের চিন্তা, তাদের কর্মধারা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, ১৯৪১-৪৫ সালে তারা যে কায়দায় পড়েছে সেটা যেন ১৯১৪-১৮-এর যুদ্ধ। ব্লিস ক্রিগ বিদ্যুৎ-গতি যুদ্ধ- এ যে কী জিনিস তারা আদপেই বুঝতে না পেরে পদে পদে আমার আদেশ অমান্য করেছে।(২)
অর্থাৎ এবার দই খাচ্ছেন হিটলার, বিকারের বেলা জাঁদরেলরা। ফ্রান্স, পোল্যান্ড জয় করেছিলেন তিনি, রুশ-যুদ্ধে হারল জর্মন জাঁদরেলরা!
কিন্তু এহ বাহ্য! কুশ-যুদ্ধে জনির হার হয়েছিল অন্য কারণে।
বহু রণপণ্ডিত একথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, সে প্রাজয়ের জন্য প্রধানত দায়ী শ্রীমান মুসোলিনি! হিটলার ২লেছেন (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৫),
ইটালি যুদ্ধে প্রবেশ করামাত্র আমাদের শত্রুদের এই প্রথম কয়েকটি সগ্রাম জয় সম্ভব হল (এস্থলে হিটলার ইংরেজ কর্তৃক উত্তর আফ্রিকা জয়ের কথা বলেছেন) এবং তারই ফলে চার্চিলের পক্ষে সম্ভব হল তার দেশবাসী তথা পৃথিবীর ইংরেজ-প্রেমীদের মনে সাহস এবং ভরসা সঞ্চার করা। এদিকে মুসোলিনি আবিসিনিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় হেরে যাওয়ার পরও গোঁয়ারের মতো হঠাৎ খামোখা আক্রমণ করে বসল গ্রিসকে আমাদের কাছে থেকে কোনও পরামর্শ না চেয়ে, এমনকি আমাদের সে সম্বন্ধে কোনও খবর না দিয়ে।(৩) খেল বেধড়ক মার; ফলে বক্কানের রাজ্যগুলো আমাদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করল। বাধ্য হয়ে, আমাদের তাবৎ প্ল্যান ভণ্ডুল করে নামতে হল বন্ধানে (এবং গ্রিসে) এবং তাতে করে আমাদের রুশ অভিযানের তারিখ মারাত্মকরকম পিছিয়ে (কাটাট্রফিক ডিলে) দিতে হল। এবং তারই ফলে আবার বাধ্য হয়ে আমাদের সৈন্যবাহিনীর কতকগুলি অত্যুত্তম ডিভিশন পাঠাতে হল সেখানে। এবং সর্বশেষে নেট ফল হল, বাধ্য হয়ে আমাদের বহুসংখ্যক সৈন্যকে খোদার-খামোখা বন্ধানের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মোতায়েন করে রাখতে হল। (হিটলার বলতে চান, তা না হলে এ সৈন্যদের রুশ অভিযানে পাঠানো যেত। পক্ষান্তরে তখন তাদের সরালে ইংরেজ ফের গ্রিসে আপন সৈন্য নামাত এবং মুসোলিনি একা যে তাদের ঠেকাতে পারতেন না, সে তো জানা কথা)!