ইরান-আফগানিস্তানে তাই অহরহ মনোমালিন্য। আফগানিস্তান ও ইরান সীমান্ত নিয়ে দুদিন বাদে বাদে ঝগড়া লাগে ও আজ পর্যন্ত সেসব ঝগড়া-কাজিয়া ফৈসালা করার জন্য কত যে কমিশন বসেছে তার ইয়ত্তা নেই। আফগানিস্তানের পশ্চিমতম হিরাত ও ইরানের পূর্বতম শহর মেশেদে প্রায়ই শিয়া-সুন্নিতে হাতাহাতি মারামারি হয়। আফগান-ইরানেতে বিয়ে-শাদি হয় না, কাবুলরাজ কখনও তেহরান যান না, ইরান-অধিপতিও কখনও কাবুলমুখো হন না। ব্যত্যয় আমানউল্লা খান এবং তার ইরান গমনের সংবাদ পেয়ে আফগানরা কিছুমাত্র উল্লসিত হয়নি।
ওদিকে যেমন ইরানের সঙ্গে আফগানিস্তানের মনের মিল নেই, এদিকে তেমনি আফগান-পাকিস্তানিতে মন-কষাকষি চলছে। সিন্ধুর পশ্চিম পার থেকে আসল পাঠানভূমি আরম্ভ হয়, এবং পূর্ব আফগানিস্তানের উপজাতি সম্প্রদায়ও পাঠান। তাই আফগান সরকারের দাবি, পাকিস্তানের পাঠান হিস্যাটা যেন তার জমিদারিতে ফেরত দেওয়া হয়। এ দাবিটা আফগানিস্তান ইংরেজ আমলে মনে মনে পোষণ করত, কিন্তু ইংরেজের ভাণ্ডার ভয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করত না।
এই তো গেল পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরানের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক বা আঁতাত কর্দিয়ালের কেচ্ছ!
ওদিকে আবার ইরান-আরবে দোস্তি হয় না। প্রথমত ধর্মের বাধা ইরান শিয়া, আরব সুনি; দ্বিতীয়ত ইরানিরা আর্য, আরবরা সেমিতি, তৃতীয়ত ইরানের ভাষা ফারসি, আরবের ভাষা আরবি।
কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর বাধা হয়েছে এই যে, খুদ আরব ভূখণ্ড ঐক্যসূত্রে গাঁথা নয়। খুদ আরবভূমি যদি এক হয়ে ইরানের ওপর তার বিরাট চাপ ফেলতে পারত তবে হয়তো ইরান প্রাণের দায়ে ভালো হোক মন্দ হোক, কোনপ্রকারে একটা দোস্তি করে ফেলত (তা সে-আঁতাত, হার্দিক, হার্টি অর্থাৎ কর্নিয়াল হল আর না-ই হল। কিন্তু তাবৎ আরব ভূখণ্ডকে এক করবার মতো তাগদ আজ কারও ভিতরেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
আরবভূমি আজ ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ট্রান-জর্ডান, সউদি আরব, প্যালেস্টাইন ও ইয়েমেন এই সাত রাষ্ট্রে বিভক্ত। তাছাড়া, কুয়েত, হাদ্ৰামুত, অধুনা নির্মিত আদন ইত্যাদি ক-গণ্ডা উপরাষ্ট্র আছে সে তো অমার! এদের সকলেরই ভাষা ও ধর্ম এক ও তৎসত্ত্বেও এদের ভিতর মনের মিল নেই। এবং সে ঐক্যের অভাব এই সেদিন মর্মন্তুদরূপে সপ্রমাণ হয়ে গেল– যেদিন কথা নেই বার্তা নেই আড়াই গণ্ডাই ইহুদি হঠাৎ উড়ে এসে আরবিস্তানের বুকের উপর প্যালেস্টাইনে জুড়ে বসল। যে আরব হাজারো বৎসর ধরে প্যালেস্টাইনের পাথর নিংড়ে সরস জাফা কমলালেবু বানিয়ে নিজে যেত, দুনিয়াকে খাওয়াত, সেই আরবের ভিটেমাটি উচ্ছন্ন করল আড়াই গণ্ডা রণভীরু ইহুদি! আরব রাষ্ট্রের আপন গৃহকলহ নিয়ে মশগুল– ওদিকে প্যালেস্টাইন পয়মাল হয়ে গেল।
লেবাননকে বাদ দিয়ে আরব সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক– কারণ লেবানন রাষ্ট্রে মুসলিম-আরবের চেয়ে খ্রিস্টান-আরবের সংখ্যা একটুখানি বেশি; লেবাননের খ্রিস্টান আরবেরা ইহুদিদের সঙ্গে দোস্তি করতে চায় না একথা খাঁটি এবং তারা হয়তো বৃহত্তর আরবভূমির পঞ্চায়েতে হাজিরা দিতে রাজি না-ও হতে পারে। কিন্তু তাতে কিছুমাত্র এসে-যায় না, কারণ লেবানন অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ রাষ্ট্র।
আসল লড়াই দুই পালোয়ানে। তাদের একজন আমির আব্দুল্লা, ট্রান্স জর্ডনের রাজা, অন্যজন মক্কা-মদিনা, জিন্দ-নেজদের রাজা ইবনে সউদ। আব্দুল্লার বংশই ইরাকে রাজত্ব করেন, কাজেই এ দু রাষ্ট্রের মিতালি পাক্কা, কিন্তু ইবনে সউদ একাই একশো। কারণ রাজা বলতে আমরা যা বুঝি সে হিসেবে আজকের দুনিয়ায় একমাত্র তিনিই খাঁটি রাজী। আব্দুল্লার পিছনে রয়েছে ইংরেজের অর্ধবল, বাহুর দম্ভ; কিন্তু ইবনে সউদ কারও তোয়াক্কা করে আপন রাজ্য চালান না! মার্কিনকে তেল বেচে তিনি এ যাবৎ কয়েকশো মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন বটে, তবু মার্কিন তার রাজত্বে কোনও প্রকারের নাম-প্রভুত্ব কায়েম করতে পারেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মক্কার কাবা শরিফের তদারকদার বিশ্বমুসলিম, সেই খাতিরে তাকে কিছুটা মানেও বটে।
যেন ঘোঁটলাটা যথেষ্ট প্যাচালো নয় তাই মিশরকেও এই সম্পর্কে স্মরণ করতে হয়। কারণ মিশরবাসীর শতকরা নব্বই জন আরবি কথা বলে, ধর্ম তাদের ইসলাম ও তাদের বেশিরভাগের রক্তও আরব-রক্ত। এবং তারচেয়েও বড় কথা, ইসলাম এবং মুসলিম ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় অছি কাইরোর সহস্রাধিক বৎসরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় অল-অজহর আরব। আফগানিস্তান, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, ভারতবর্ষ, চীন, মালয়, জাভা এক কথায় তাবৎ দুনিয়ার কুল্লে ধর্মপ্রাণ মুসলিমের আন্তরিক কামনা অজহরে ধর্মশিক্ষা লাভ করবার।
তদুপরি মিশর প্রগতিশীল এবং বিত্তশালী রাষ্ট্রও বটে।
কিন্তু মিশরের উপরে রয়েছে ইংরেজের সরদার।
সেই হল আরেক বখেড়া। আরবদের ভিতর ঝগড়া-কাজিয়া তো রয়েছেই, তার ওপর আবার আরব হাঁড়ির ভিতর গর্দান ঢুকিয়ে বসে আছেন ইংরেজ এবং স্বয়ং মার্কিন চতুর্দিকে ছেক-ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, হাঁড়ির কিছুটা স্নেহজাতীয় পদার্থ ইতোমধ্যেই তাঁর লাজুলকে কিঞ্চিৎ চেকনাই এনে দিয়েছে সেকথা পূর্বেই নিবেদন করেছি।
তাই সবকিছু ছয়লাপ করে দেয় তেলের বন্যা। ইরান-ইরাকের তেল ইংরেজের আর সউদি আরবের তেল মার্কিনের। পাঠক বলবেন, তা হলেই হল, ব্রাদারলি ডিভিশন, কিন্তু সুশীল পাঠক, আপনি উপনিষদ পড়েননি তাই এরকম ধারা বললেন। ভূমৈব সুখম- অল্পে সুখ নেই। মার্কিন চায় তৈলযজ্ঞের একক পুরোহিত হতে, আর ইংরেজ চায় মার্কিনকে দরিয়ার সে-পারে খেদাতে।