আমরা যদি হাম-বড়াই প্রমত্ত হয়ে দেশ-বিদেশে সর্বত্র এরকম ধারা ভাবখানা দেখাই যে কারও কাছে আমাদের কিছু শেখবার নেই, আমাদের পুরাণাদি অনুসন্ধান করলে এটম বম্ বানানোর কৌশল খুঁজে পাওয়া যায়, আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধির সামনে যে লোক মাথা না নেওয়ায় সে আকাট মূর্খ, আমরা যদি দেশ-বিদেশে আপন সামাজিক জীবনে পাঁচজনকে নিমন্ত্রণ করে, নিমন্ত্রণ রেখে হৃদ্যতাযোগে সকলের সঙ্গে এক না হতে পারি তবে আমরা বৈদেশিক রাজনীতিতে মার খাব–বেধড়ক মার খাব, সে বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।
যুদ্ধের সময় কত মার্কিন, ফরাসি, চেক, বেলজিয়াম আমার কাছে ফরিয়াদ করেছে, বাঙালিদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ তারা পেল না। এক মার্কিন আমাদের একখানা বাজে ইংরেজি কাগজের রবিবাসরীয় পড়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, তোমরা যদি এরকম ইংরেজি লিখতে পার তবে বাঙলাতে তোমাদের চিন্তাধারা কত না অদ্ভুত খোলতাই হয় তার সন্ধান পাব কী প্রকারো বাঙলা শেখবার মতো দীর্ঘকাল তো আর এদেশে থাকব না, তাই অন্তত দু-চারজন গুণীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও, দু-দণ্ড রসালাপ আর তত্ত্বালোচনা করে লড়াইয়ের খুনকলের কথাটা যাতে করে ভুলে যেতে পারি।
আলাপ করিয়ে দিলুম কিন্তু জমল না।
আমার বাঙালি বন্ধুরা যে জাত মানেন তা নয়, কিংবা মার্কিন ভদ্রলোকটি যে আমাদের ঠাকুরঘরে বসে গোমাংস খেতে চেয়েছিলেন তা-ও নয়, বেদনাটা বাজল অন্য জায়গায়।
আলাপ-পরিচয়ের দুদিন বাদেই ধরা পড়ে, আমাদের মনের জানালাগুলো সব বন্ধ। আমরা করি সাহিত্যচর্চা ও কিঞ্চিৎ রাজনীতি। নিতান্তু যারা অর্থশাস্ত্র পড়েছেন, তাদের বাদ দিলে আমাদের রাজনীতিচর্চাও নিতান্ত একপেশে; আর আমাদের নিজেদের দর্শন, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, নৃত্য সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান অত্যল্প। ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খানিকটে আছে বটে কিন্তু ইয়োরোপীয় বৈদগ্ধের আর পাঁচটা সম্পদ সম্বন্ধে আমরা অচেতন।
তাই গালগল্প ভালো করে জমে না। যে আমেরিকান পঁচিশপদী খানা পায় তাকে দুবেলা ডালভাত দিলে চলবে কেন? রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধী, গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথ করে তো আর দিনের পর দিন কাটানো যায় না।
এরচেয়ে আশ্চর্যের জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। কারণ এখনও আমাদের যেটুকু বৈদগ্ধ্য আছে, যে সম্পদ সম্বন্ধে আমাদের বেশিরভাগ লোকই অচেতন, সেটুকু গড়ে উঠেছে এককালে আমাদের মনের সবকটি জানালা খোলা ছিল বলে।
শুধু তাজমহল নয়, সমস্ত মোগল-পাঠান স্থাপত্য– জামি মসজিদ, আগ্রা দুর্গ, হুমায়ুনের কবর, সিক্রি এবং তার পূর্বেকার হৌজবাস, কুত্ত্বমিনার সবকিছু গড়ে উঠল ভারতবাসীর মনের জানালা খোলা ছিল বলে; দিল্লি-আগ্রার বাইরে যেসব স্থাপত্যশৈলী রয়েছে, যেমন ধরুন আহমদাবাদ বাঙলা দেশ কিংবা বিজাপুরে সেগুলোও তাদের পরিপূর্ণতা পেয়েছে, এককালে আমাদের মনের দরজা খোলা ছিল বলে; খানসাহেব আব্দুল করীম খান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে চরমে পৌঁছতে পেরেছিলেন তার সোপান নির্মিত হয়েছে ভারতীয় পূর্বাচার্যগণের ঔদার্যগুণে।
এই বাঙলা ভাষা আর সাহিত্যই নিন। বৌদ্ধচর্যাপদে তার জন্য, তার গায়ে বৈষ্ণব পদাবলির নামাবলি, মঙ্গল-মুকুট তার শিরে, আরবি-ফারসি শব্দের খানা খেয়েছে সে বিস্তর আর তার কথার ফাঁকে ফাঁকে যে ইংরেজি বোল ফুটে ওঠে তার জ্বালায় তো মাঝে মাঝে প্রাণ অস্থির হয়ে ওঠে।
আর কিছু না থোক আরবি-ফারসির যে দুটো জানালা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। যেগুলো সামান্য ফাঁক করে দিয়েই কবি নজরুল ইসলাম আমাদের গায়ে তাজা হাওয়া লাগিয়ে দিলেন সেগুলোই যদি আমরা পুনরায় খুলে ধরি তা হলে আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, মিশর, লিবিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে। আফগানিস্তান ও ইরানে ফারসি প্রচলিত আর বাদবাকি দেশ আরবি।
স্বার্থের সন্ধানে একদিন আমরা তাদের কাছে যাব, তারাও আমাদের অনুসন্ধান করবে। তখন যদি তারা আমাদের যতটা চেনে তারচেয়ে তাদের সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বেশি হয় তবে আমরাই জিতব।
আর পুবের জানালাও তো খুলে ফেলা সহজ। বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটক তো ভারতের পিটকেই বন্ধ আছে। ত্রিশরণ ত্রিরত্নের রত্নাকর তো আমরাই।
.
০২.
পশ্চিমের জানালা খুললে দেখতে পাই, পাকিস্তান ছাড়িয়ে আফগানিস্তান, ইরান, আরব দেশের পর ভূমধ্যসাগর, অর্থাৎ ভারত এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী ভূমি মুসলিম। তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিশাল ভূখণ্ড যদি ধর্মের উদ্দীপনায় ঐক্যলাভ করতে পারে তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-পঞ্চায়েতে এদের উচ্চকণ্ঠ কি মার্কিন, কি রুশ কেউই অবহেলা করতে পারবে না।
তার পূর্বে প্রশ্ন, বহুশত বৎসর ধরে এ ভূখণ্ডে কোনওপ্রকারের স্বাধীন ঐক্য যখন নেই তখন আজ হঠাৎ কী প্রকারে এদের ভিতর একতা গড়ে তোলা সম্ভব? উত্তরে শুধু এইটুকু বলা চলে যে, এ ভূখণ্ডে ইতোপূর্বে আর কখনও এমন কট্টর জীবনমরণ সমস্যা উপস্থিত হয়নি। তাই আজ যদি প্রাণের দায়ে এরা এক হয়ে যায়!
ঐক্যের পথে অন্তরায় কী?
প্রথম অন্তরায় ধর্মই। ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে যেমন বর্মা-চীন এবং অন্যদিকে মুসলিম ভূমি, ঠিক তেমনি শিয়া ইরানের একদিকে সুন্নি আফগানিস্তান-পাকিস্তান এবং ভারতীয় মুসলমান, অন্যদিকেও সুন্নি আরবিন্তান। শিয়া ইরানের সঙ্গে সুন্নি আফগানিস্তানের মনের মিল কখনও ছিল না, এখনও নেই। একটা উদাহরণ দিলেই আমার বক্তব্যটা খোলসা হবে; আফগান বিদগ্ধজনের শিক্ষাদীক্ষা এবং রাষ্ট্রভাষা ফারসি, আর ইরানের ভাষা তো ফারসি বটেই, তৎসত্ত্বেও কাবুলের লোক কস্মিনকালেও ইরানে লেখা-পড়া শেখবার জন্য যায়নি এবং তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় যে তারা লেখা-পড়া এবং ধর্ম-চর্চার জন্য আসত ভারতবর্ষে, এখনও আসে, যদ্যপি সকলেই জানে যে, ভারতবর্ষের কোনও প্রদেশের লোকই ফারসিতে কথা বলে না। ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বেও তাই ছিল– আফগানিস্তান এককালে বৌদ্ধ ছিল, তার পূর্বে সে হিন্দু ছিল, কিন্তু ইরানি জরথুস্ত্র ধর্ম সে কখনও ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেনি।