রামমোহন রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সর্বদেশেই বিরল। এদেশে তো অবশ্যই।
ইতোমধ্যে আর একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
এতদিন যে হিন্দু পণ্ডিত দার্শনিক মুসলমানের ধর্ম আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করেননি তাতে হয়তো তাদের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, কিন্তু স্বরাজলাভের পর তাদের সে দৃষ্টিবিন্দু পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তান ইরান ইরাক সিরিয়া সউদি-আরব ইয়েমেন মিশর তুনিস আলজিরিয়া মরক্কো তথা মুসলমানপ্রধান ইন্দোনেশিয়া ও নবজাগ্রত মুসলিম অধ্যুষিত আফ্রিকার একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা স্থাপন করতে হবে। মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানও এ ফিরিস্তির অন্তর্ভুক্ত। এদের ধর্ম, তার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক বাতাবরণ-পার্থক্যে তাদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ-পরিবর্তন–এসব এখন অল্পবিস্তর অধ্যয়ন না করে গত্যন্তর নেই। সত্য, আমাদের স্কুল-কলেজে এখনও আরবি-ফারসির চর্চা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি, কিন্তু এই নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়াটা সমীচীন হবে না। কিছু কিছু হিন্দুদেরও আরবি-ফারসি শিখতে হবে। এবং এই সাতশো বৎসরের প্রাচীন আরবি-ফারসির শিক্ষাপদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ যতই প্রয়োজনীয় হোক, এস্থানে কিঞ্চিৎ অবান্তর।
আমরা যে মূল উৎসের সন্ধানে বেরুচ্ছি তার জন্য আজ আর প্রাচীন মানচিত্র কাজে লাগবে না। ভাবোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ অথবা সন্দেহে সন্দেহে কন্টকাকীর্ণ প্রাচীন কোনও পদ্ধতির অনুসরণ করলে আজ আর চলে না। ধর্মকেও আজ রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির কষ্টিপাথর দিয়ে যাচাই করতে হয়।
কিন্তু অনুসন্ধিৎসু মনের সঙ্গে থাকবে সহানুভূতিশীল হৃদয় ॥
————
১. টয়িনবি সাহেব যে রীতিতে পৃথিবীর সর্বত্র একই প্যাটার্নের অনুসন্ধান করেন বর্তমান লেখক সে নীতি অনুসরণে বিরত থাকবে। শুধু যেখানে প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি দেখিয়ে দিলে আলোচ্য বিষয়বস্তু স্পষ্টতর হবে সেখানেই এই নীতি মানা হবে। এস্থলে তাই শুধু উল্লেখ করি, যখনই কোনও জাতি বৈদেশিক কোনও ভিন্নধর্মাবলম্বী দ্বারা পরাজিত হয় তখন নতুন রাজা এদের পণ্ডিতমণ্ডলীকে কোনও প্রধানকর্মে আমন্ত্রণ জানান না বলে এদের এক মানসিক পরিবর্তন হয়। এদের চিন্তাধারা তখন মোটামুটি এই; আমাদের ধর্ম সত্য, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমরা ম্লেচ্ছ বা যবন কর্তৃক পরাজিত হলুম কেন? এর একমাত্র কারণ এই হতে পারে যে, আমরা আমাদের ধর্মের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারিনি। ধর্মের অর্থকরণে (ইন্টারপ্রিটেশনে) নিশ্চয়ই আমাদের ভুল রয়ে গিয়েছে। আমরা তা হলে নতুন করে ব্যাখ্যা করে দেখি, ক্রটি কোন স্থলে হয়েছে। ফলে পরাজয়ের পরবর্তী যুগে তাবৎ সৃষ্টিশক্তি টীকাটিপ্পনী রচনায় ব্যয় হয়।
২. ইসলামের অন্যতম প্রখ্যাত পথপ্রদর্শক বা ইমাম। ইনি দার্শনিক কিয়ৎকালের জন্য নাস্তিক এবং পরিণত-বয়সে সুফি (মিষ্টিক, ভক্তিমার্গ ও যোগের সমন্বয়কারী) হয়ে যান। এর জনপ্রিয় পুস্তক কিমিয়া সাদৎ এই শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় অনূদিত হয়ে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ স্বৰ্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী এই পুস্তকের বড়ই অনুরাগী ছিলেন এবং আমাদের মন্দিরের উপাসনায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। বিধুশেখর অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ টোলো পণ্ডিত ছিলেন। স্মরণ রাখবার সুবিধার জন্য উল্লেখযোগ্য- গজ্জালির মৃত্যু ১১১১ খ্রিস্টাব্দে।
বন্ধ-বাতায়নে
ইংরেজকে যত দোষই দিই না কেন, ইংরেজি সভ্যতার যত নিন্দাই করি না কেন, ইংরেজ যে একটা মহৎ কর্ম সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একদিক দিয়ে বহু জাত-বেজাত ইংলন্ড দখল করেছে, অন্যদিক দিয়ে ইংরেজ বিশ্বভুবনময় ছড়িয়ে পড়েছে, এবং তার ফলে ইংলন্ডে যে কত প্রকারের ভাবধারা এসে সম্মিলিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই নানা ঘাত-প্রতিঘাতী পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা, রসবোধ পদ্ধতি, আদর্শানুসন্ধান যখন পৃথকভাবে যাচাই করি তখন বিস্ময়ের আর অন্ত থাকে না যে, ইংরেজ কী করে সবকটাকে এক করে বহুর ভিতর দিয়ে ঐক্যের সন্ধান পেল।
কাব্যকলায় ইংরেজের যে খুব বেশি মৌলিক গুণ আছে তা নয়–ইয়োরোপীয় সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্রকলায় ইংরেজের দান অতি অল্পই কিন্তু মনের সবকটি জানালা ইংরেজ সবসময়ই খোলা রেখেছে বলে বহু প্রমর তার ঘরে এসে নানা গুঞ্জন গান তুলেছে, নানা ফুলের সুবাস তার বৈদগ্ধ্যকে সুবাসিত করে তুলেছে। সে বৈদগ্ধের প্রকাশও তাই সুভাষিত।
অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এই নানা বস্তু অন্তরে গ্রহণ করার ক্ষমতার পিছনে রয়েছে সহিষ্ণুতা। এ গুণটি বড় মহৎ, এবং জর্মন জাতির এ গুণটি নেই বলেই তারা বহু প্রতিভাবান কবি, গায়ক, দার্শনিক পেয়েও কখনওই ইয়োরোপে একচ্ছত্রাধিপত্য করতে পারেনি।
ইংরেজরাজত্বের সময় আমাদের প্রধান কর্ম ছিল ইংরেজকে খেদানোর কল-কৌশল বের করা। আমরা সহিষ্ণু এবং উদার কি না, দুবাইগ্রস্ত এবং কূপমণ্ডুক- এ প্রশ্ন জিগ্যেস করবার ফুরসত এবং প্রয়োজন আমাদের তখন ছিল না।
এ প্রশ্ন জিগ্যেস করবার সময় আজ এসেছে।
আমাদের বৈদেশিক রাজনীতি সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আমাদের চরিত্রের ওপর।