পক্ষান্তরে মুসলমান যে আরবি দর্শন সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাই নিয়ে পড়ে রইলেন। মঙ্গোল কর্তৃক বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার পর, এবং স্পেন থেকে মুররা বিতাড়িত হওয়ার ফলে আরব-জগতে দর্শনের অপমৃত্যু ঘটে। এদেশের মুসলমান দার্শনিককে অনুপ্রাণিত করার জন্য বাইরের সর্ব উৎস সম্পূর্ণ ও হল। হায়, এরা যদি পাকে-চক্রে কোনওগতিকে ষড়দর্শনের সন্ধান পেতেন।
এ তো কিছু অসম্ভব কল্পনা-বিলাস নয়। আজকের দিনের হিন্দু দার্শনিক একদিকে নব্যন্যায় চর্চা করেন, অন্যদিকে দেকার্ত অধ্যয়ন করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এদের পথ-প্রদর্শক। কবি ইকবালের ঐতিহ্যভূমি আভেরস আভেচেন্নার উপর তার সৌধনির্মাণে তিনি সাহায্য নিয়েছেন কান্ট-হেগেলের।
আমরা এতক্ষণ যে অবস্থার বর্ণনা করলেম তার থেকে আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত করা সম্পূর্ণ অনুচিত নয় যে, ভারতবর্ষে তা হলে হিন্দু-মুসলমানের মিলন হয়নি। যেহেতু ব্রাহ্মণের দেবোত্তর বাদশা কেড়ে নেননি তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে আপন শাচর্চা করে যেতে লাগলেন, এবং যেহেতু আলিম-ফাজিলরা ওয়াকফু-সম্পত্তি পেয়ে গেলেন তাই তারাও পরমানন্দে তাঁদের মক্তব-মাদ্রাসায় কোরান-হাদিসের চর্চা করে যেতে লাগলেন। একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করার কোনও প্রয়োজন অনুভব করলেন না।
কিন্তু দেশের সকলের তো লাখেরাজ ব্রহ্মোত্তর ওয়াকফু-সম্পত্তি নেই। চাষা তিলি জোলা কাসারি মাঝি চিত্রকর কলাবৎ বৈদ্য কারকুন এবং অন্যান্য শত শত ধান্দার লোককে অর্থোপার্জন করে জীবনধারণ করতে হয়। সে স্থলে হিন্দু মুসলমানকে বর্জন করে চলতে পারে না, মুসলমানকেও হিন্দুর সংস্পর্শে আসতে হয়। তদুপরি উচ্চাঙ্গের চিত্রকলা সঙ্গীত স্থাপত্য বাদশা ও তার অর্থশালী আমির-ওমরাহের সাহায্য বিনা হয় না। বাদশারও দরকার হিন্দু রাজকর্মচারীর। কোনও দেশ জয় করা এক কর্ম, সে দেশ শাসন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া। বাদশা ইরান-তুরান থেকে দিগ্বিজয় করার সময় রাজকর্মচারী সঙ্গে আনেননি। আর আনবেনই-বা কী? তারা এ-দেশের ভাষা জানে না, রাজস্বব্যবস্থা বোঝে না, কোন দণ্ডনীতি কঠোর আর কোনটাই-বা অতি সদয় বলে দেশের লোকের মনে হবে এ সম্বন্ধে তাদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। বখশি (চিফ পে-মাস্টার, অ্যাকাউন্টেন্ট-ক-অডিটার জেনারেল), কানুনগো (লিগেল রিমেমব্রেনসার), সরকার (চিফ সেক্রেটারি), মুনশি (হুজুরের ফরমান লিখনেওলা, নতুন আইন নির্মাণের খসড়া প্রস্তুতকারী), ওয়াকে-নয়িস (যার থেকে waqmis), পর্চা-নওয়িস (রাজকর্মচারীর আচরণ তথা দেশের জনসাধারণ সম্বন্ধে রিপোর্ট তৈরি করনেওলা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করবে কারা?
আমরা জানি, কায়স্থরা স্মরণাতীত কাল থেকে এসব কাজ করে আসছেন। এরাই এগিয়ে এলেন। মুসলমান প্রাধান্য প্রায় দুশো বসর হল লোপ পেয়েছে, কিন্তু আজও এসব পদবি— প্রধানত কায়স্থদের ভিতর সম্পূর্ণ লোপ পায়নি।
এদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, উর্দু ভাষা এবং অন্যান্য বহু জিনিস যে হিন্দু-মুসলমানের অনিবার্য মেলামেশার ফলে হয়েছিল সেকথা সকলেই জানেন।
শুধু ভাস্কর্য ও নাট্যকলা বাদশা-আমির-ওমরার কোনও সাহায্য পায়নি। তার কারণ, ইসলামে মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ এবং নাট্যকলা ভারতের বাইরে মুসলিম জগতের সম্পূর্ণ অজানা।
হিন্দুধর্ম ভিন্নধর্মাবলম্বীকে আপন ধর্মে গ্রহণ করে না। কাজেই অন্য ধর্ম সম্বন্ধে তার ঔৎসুক্য নেই। মুসলমান বিধর্মীকে মুসলমান করতে চায়। উভয়ের মিলনের চিন্তা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কিংবা মুসলমান মৌলবি কেউ করেন না। হিন্দু পণ্ডিত মুসলমানকে বলেন, তুমি দূরে থাকো। মুসলমান মৌলবি হিন্দুকে বলেন, এস, তুমি মুসলমান হবে। তৃতীয় পন্থাও যে থাকতে পারে সেটা কারও মনে উদয় হয় না। হিন্দু হিন্দু থাকবে, মুসলমান মুসলমান থাকবে অথচ উভয়ের মধ্যে মিলন হবে, হৃদ্যতা হবে।
এ পন্থার চিন্তা করেছিল জনগণ। এটাতে ছিল তাদের প্রয়োজন। তাই এলেন ধর্মের জগতে জননেতা, জনাবতার কবীর দাদু নানক ইত্যাদি। পরম শ্লাঘার বিষয়, শান্তিনিকেতনেই এদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। এতদিন ধরে ভারতের হিন্দু-মুসলমান গুণী-জ্ঞানীরা যেসব মহাপুরুষদের সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন, শান্তিনিকেতনেই সে-সময়ের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী তাদের নিয়ে সমস্ত জীবন ব্যয়িত করেন। তার দাদু কবীরের পরিচয় এস্থলে নতুন করে দেবার প্রয়োজন নেই।
সে পুণ্যকর্ম এখনও বিশ্বভারতীতে পূর্ণোদ্যমে অগ্রগামী। ক্ষিতিমোহনের বৃদ্ধ বয়সের সহকর্মী বিশ্বভারতীর অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রামপূজন তিওয়ারির সুফিমত-সাধনা ঔর সাহিত্য সুচিন্তিত স্বয়ংসম্পূর্ণ পুস্তক হিন্দি সাহিত্য তথা মধ্যযুগীয় লোকায়ত ধর্ম-চর্চার গৌরব বৃদ্ধি করেছে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ সরল ভাষায় লিখিত এ ধরনের গ্রন্থ সর্ব ভাষায়ই বিরল।
কিন্তু চিন্তাজগতে দর্শন-ধর্মশাস্ত্র-জ্ঞানবিজ্ঞানে হিন্দু-মুসলমানের মিলনভাব অথচ অনুভূতির ক্ষেত্রে চারুকলা সঙ্গীত লোকসাহিত্যে গণধর্মে আশাতীত মিলন। এ বিষয়ে অধ্যয়ন এবং চর্চা করতে হলে উভয় জনসমাজের মূল ধর্ম, সামাজিক আচার-ব্যবহার গোড়া থেকে অধ্যয়ন করতে হয়। হিন্দুধর্ম ও সমাজ সম্বন্ধে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু মুসলমান ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় প্রায় কিছুই নেই। যা-কিছু আছে তা সরল ধর্মোদ্দাসে পরিপূর্ণ এবং স্বধর্মবিশ্বাসীর হৃদয় মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করার জন্য– বিধর্মীর সম্মুখে আপন ধর্ম যুক্তিবিচারের ওপর নির্মাণ করে তাকে আকর্ষণ করার কোনও প্রচেষ্টা তাতে নেই, আপন ধর্মের স্বতঃসিদ্ধ নীতিও যে বিধর্মীর কাছে প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ হতে পারে সে দুশ্চিন্তাও এ সাহিত্যকে বিক্ষুব্ধ করেনি। উপরন্তু ইংরেজ-আগমনের পর এদেশের ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দুরা ইংরেজির মারফতে পেলেন ইসলামের এক বিকট বিকৃত রূপ। সরল হিন্দু জানত না, খ্রিস্টান এবং মুসলিমে স্বার্থসংঘাত লেগে যায় মহাপুরুষের মৃত্যুর অল্পদিন পরেই, শত শত বত্সর ক্রুসেডের নামে একে অন্যের মরণালিঙ্গনে তারা সস্পিষ্ট; ফলে খ্রিস্টান কর্তৃক ইসলাম ও হজরত মুহম্মদের বিরুদ্ধে অকথ্য কটুবাক্য এদেশে এসেছে নিরপেক্ষ গবেষণার ছদ্মবেশ ধরে। সাধারণ সরল হিন্দু এ ছদ্মবেশ বুঝতে পারেনি। (এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুসলমান কিন্তু খ্রিস্টানকে প্রাণভরে জাত তুলে গালাগাল দিতে পারেনি, কারণ কুরান-শরিফ যিশুখ্রিস্টকে অন্যান্য মহাপুরুষদের একজন বলে যে স্বীকার করে নিয়েছেন তাই নয়, তিনি মুহম্মদের পূর্বে সর্বপ্রধান পয়গম্বর বলে তাকে বিশেষ করে রুহুল্লা আল্লার আত্মা পরমাত্মার খণ্ডাত্মা উপাধি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে খ্রিস্টান যুগ যুগ ধরে হজরত মুহম্মদকে ফল প্রফেট শার্লট্যান ইত্যাদি আখ্যায় বিভূষিত করেছে। প্রায় চল্লিশ বৎসর পূর্বেও ঐতিহাসিক ওয়েলস্ তাঁর বিশ্ব-ইতিহাসে মুহম্মদ যে ঐশী অনুপ্রেরণার সময় স্বেদসিক্ত বেপথুমান হতেন তাকে মৃগরিগরি লক্ষণ বলে মহাপুরুষকে উভয়ার্থে লাঞ্ছিত করেছেন)।