সরষের তেলে সবকিছু আলতো আলতো করে মাখিয়ে নেওয়ার পর তার উপরে ঢালবেন পাতি বা কাগজি নেবুর রস। নুন। সবকিছু ফের আলতো আলতো করে মাখুন। ব্যস্ স্যালাড তৈরি।
নেবুর রসের বদলে অনেকেই ভিনিগার বা সিরকা দেয়। তার কারণ ইয়োরোপে ওই ভিনিগার ছাড়া অন্য কোনও টক বস্তু নেই। নেবুর রসের বদলে যদি ভিনিগার ব্যবহার করেন তবে সেটা জল দিয়ে ডাইলুট অর্থাৎ কম-তেজ করে নেবেন।
প্রশ্নটা, কতখানি লেটিসের সঙ্গে কতখানি পেঁয়াজ, টমাটো, শসা, তেল, নেবুর রস দেব? এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে মনে রাখা উচিত, লেটিস পাতাই হবে প্রধান জিনিস, সে-ই যেন বাকি সব জিনিসের উপর প্রাধান্য করে। পাতাগুলো তেলতেলে হওয়ার মতো তেলে মাখানো হবে, কিন্তু জবজবে যেন না হয়। নেবুর রস তেলের এক সিকি ভাগের মতো। বেশি টকটক যেন মনে না হয়; এবং খাবার সময় লেটিস পাতা যেন আর পাঁচটা জিনিসের চাপে আপন স্বাদ না হারায়।
এ স্যালাড অন্য পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে খেতে হয়। অর্থাৎ ডাল-ভাত, ভাত-ঝোল, ভাত-মাংস, একগ্রাস মুখে দেবার পর খানিকটা স্যালাড মুখে নিয়ে একসঙ্গে চিবোবেন। স্বাধীন পদ হিসেবে যে স্যালাড খাওয়া হয় সেটাতে মাছ, মাংস কিংবা ডিম থাকে, এবং মায়োনেজ দিয়েই তৈরি করা হয়। (ডিমের হলদে ভাগের সঙ্গে তেল-সিরকা দিয়ে মেখে মেখে সেটা তৈরি করতে হয়; বড্ড খুঁটিনাটি বলে বাজারে তৈরি মায়োনেজ বোতলে পাওয়া যায়, টমাটো সসেরই মতো, যদিও ইটালিয়ান প্রতিদিন তাজা টমাটো সস বাড়িতেই বানায়, আমরা যেরকম বাজারের কারি পাউডার না কিনে নিজেরাই হরেক জিনিস বেটে-গুলে রান্নায় ব্যবহার করি। সেসব স্বাধীন পদের স্যালাড বানাতে এটা ওটা সেটা এবং সময়ও লাগে বেশি তদুপরি সবচেয়ে বড়কথা বাঙালি রান্নার আর তিনটে পদের সঙ্গে ওটা ঠিক খাপ খায় না।
অনেকে আবার তেল-নেবুর রস ব্যবহার না করে লেটিসপাতা-টমাটো-প্যাজ সবকিছু টক দইয়ে মেখে নেন, উপরে গোলমরিচের গুড়ো ছিটিয়ে দেন। আমার তো ভালোই লাগে।
কাবুলিরা ব্যত্যয়। তারা শুধু লেটিস পাতা একঠোঙ্গা মধুতে গুতা মেরে খেয়ে চলে রাস্তায় যেতে যেতে।
আমাদের দেশে শীতকালেও রোদ কড়া বলে লেটিস ভালো হয় না। তাই এদেশে লেটিস ফলাতে জানেন অল্প লোকই। লেটিস ক্ষেত যেন দিনে অল্পক্ষণের জন্য পুবের রোদ পায়, সার যেন বেশি না দেওয়া হয়, এবং জলসেচের পরিমাণ নির্ণয় কঠিন। মোট কথা, লেটিস যেন বড্ড বেশি প্রাণবন্ত না হয়। তাকে যেন খানিকটে জীবন্ত রাখা হয়। লেটিস পাতা পান ও তামাকপাতার মতোই বড় ডেলিকেট লাজুক কোমল প্রাণ। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বরজের মতো কোনও একটা ব্যবস্থা করে লেটিস ফলিয়ে দেখলে হয়।
এখন সর্বশেষ প্রশ্ন, আমি স্যালাড নিয়ে অত পাঁচ কাহন লিখছি কেন?
প্রথম: স্যালাড জিনিসটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। যে কোনও ডাক্তারকে শুধোতে পারেন।
দ্বিতীয় : বাঙালি গরিব জাত। লেটিস সস্তা এবং স্যালাড বানাতে আর যেসব জিনিস লাগে সেগুলো বাঙালির ঘরে ঘরে কিছু-না-কিছু থাকে। প্রত্যেককে একটি স্যালাড দিতে খর্চা তেমন কিছুই নয়। ডাল ভাত মাছ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি গ্রাস কিংবা দ্বিতীয় তৃতীয় গ্রসে কিছুটা স্যালাড খেলে ওই দিয়ে পেটের কিছুটা ভরে। একটা হাফ-পদও হল। পরে যদি স্যালাডে আপনার রুচি জন্মে যায় তবে আপনি তার পরিমাণ বাড়িয়ে পেটের আরও বেশি ভরাতে পারবেন।
তৃতীয় : স্যালাড এক্সপেরিমেন্ট করে করে অনেককিছু দিয়ে তার পরিমাণ বাড়ানো যায়। আলুসেদ্ধ চাকতি চাকতি করে (এমনকি আগের রাতের বাসি ঝোলের আলুগুলো তুলে নিয়ে, ধুয়ে, চাকতি চাকতি করে), মটরটি সেদ্ধ করে, গাজর বিট ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই তাতে দেওয়া যায়। এমনকি ঠাণ্ডা হাফবয়েলড ডিমও চাকতি চাকতি করে দেওয়া যায় তবে ওটা স্যালাড তৈরি হয়ে যাবার পর সর্বশেষে; নইলে ওঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে, অতি আলতো আলতোভাবে মাখাবার সময়ও। অর্থাৎ বাড়ির কোনওকিছু খামকা বরবাদ হয় না। এমনকি আগের রাতের মাছ-মাংস দিয়েও স্যালাড করা যায় তবে সে অন্য মহাভারত, পদ্ধতি আলাদা।
সর্বশেষে পাঠক, এবং বিশেষ করে পাঠিকাকে সাবধান করে দিচ্ছি, স্যালাড এমন কিছু ভয়ঙ্কর সুখাদ্য নয়, (দেখতেই পাচ্ছেন, যেসব মাল দিয়ে স্যালাড তৈরি হয় সেগুলো এমন কিছু মারাত্মক মূল্যবান সুখাদ্য নয় যে আপনি হন্তদন্ত হয়ে স্যালাড তৈরি করে খেয়ে বলবেন, ও হরি! এই মালের জন্য আলী সাহেব এতখানি বকর বকর করল।
মনে পড়ল, এক মহিলাকে আমি কথায় কথায় এক বিশেষ ব্র্যান্ডের সাবান ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছিলুম। দিন সাতেক পরে তার সঙ্গে রাস্তায় দেখা। নাক সিঁটকে বললেন, তা আর এমন কী সাবান! আমি বললুম, ম্যাডাম, আপনি কি আশা করেছিলেন যে ওই সাবান ব্যবহার করার সাত দিনের মধ্যেই আপনার কর্তা আপনাকে নতুন গয়না গড়িয়ে দেবেন! ১৪ ক্যারেটের আগের কথা বলছি।
অ্যারোপ্লেন
০১.
পঁচিশ বৎসর পূর্বে প্রথম অ্যারোপ্লেন চড়েছিলাম। দশ টাকা দিয়ে কলকাতা শহরের উপর পাঁচ মিনিটের জন্য বুশ সোওয়ারি বা জয়-রাইড নয়, রীতিমতো দুশো মাইল রাস্তা পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে নদী-নালা পেরিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহর যেতে হয়েছিল। তখনকার দিনে এদেশে প্যাসেঞ্জার সার্ভিস ছিল না, কাজেই আমার অভিজ্ঞতাটা গড়পড়তা ভারতীয়দের পক্ষে একরকম অভূতপূর্বই হয়েছিল বলতে হবে।*[* রচনাটি লেখা হয় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে।]