প্রায় ছ শো বৎসর ধরে এদেশে ফারসিচর্চা হল। হিন্দুরা না হয় বিদেশাগত ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি কৌতূহল না দেখাতে পারেন, কিন্তু যাদের রাজ্যচালনা করতে হয়েছে তাদের বাধ্য হয়ে এদেশের ভাষা রীতিনীতি অল্পবিস্তর শিখতে হয়েছে। উত্তম সরকারি কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দুও ফারসি শিখেছিলেন। মাত্র একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে : এদেশে বহু হিন্দুর পদবি মুনশি। আমরা বাঙলায় বলি, লোকটির ভাষায় মুন্সিয়ানা বা মুনশিয়ানা আছে, অর্থাৎ সে নাগরিক বিদগ্ধ চতুর (স্কিলফুল) ভাষা লেখে। এর থেকেই বোঝা যায়, কতখানি ফারসি জানা থাকলে তবে মানুষ বিদেশি ভাষায় এরকম একটা উপাধি পায়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে : আমরা প্রচুর ইংরেজি চর্চা করেছি, কিন্তু ইংরেজ মুশি-জাতীয় কোনও উপাধি আমাদের কাউকে দেয়নি-বরঞ্চ আমাদের ব্যাবু ইংলিশ নিয়ে ব্যঙ্গই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সবিস্তর আলোচনা পরে হবে। উপস্থিত এইটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই মুশি-শ্রেণির যারা উত্তম ফারসি শিখেছিলেন তাদের অধিকাংশই কায়স্থ, সংস্কৃতের পটভূমি তাদের ছিল না, কাজেই উভয় ধর্মশাস্ত্রের সম্মেলন করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। উপরন্তু এরা ফারসি শিখেছিলেন অর্থোপার্জনের জন্য জ্ঞানান্বেষণে নয়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে, আমরা প্রায়ই দুইশো বৎসর ইংরেজি বিদ্যাভ্যাস করেছি বটে, তথাপি খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাঙলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন অতি অল্পই অনুভব করেছি।
শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। কথিত আছে বৃন্দাবন থেকে সশিষ্য ৰাঙলা দেশে আসার সময় পথিমধ্যে এক মোন্নার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই মোল্লা নাকি তাকে প্রশ্ন করেন, তিনি তাঁর শিষ্যদের ভ্রান্ত ধর্মপথে চালনা করছেন কেন? শ্রীচৈতন্যদেব নাকি তখন মুসলমান শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, তিনি ভ্রান্ত ধর্মপ্রচার করছেন না। মুসলমান ধর্মে বলা হয়, যে লোক আর্তের সেবা করে, মিথ্যাচরণ বর্জন করে সৎপথে চলেঅর্থাৎ কুরান-শরিফ-বর্ণিত নীতিপথে চলে–তাকে পয়গম্বরহীন মুসলমান বলা যেতে পারে, হজরত মুহম্মদকে পয়গম্বররূপে স্বীকার করেনি বলেই সে ধর্মহীন নয়। (আমরা এস্থলে কাফির না বলে ধর্মহীন শব্দ ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছি; পরে এর বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন হবে)। অতএব অনুমান করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয় যে, বোধহয় চৈতন্যদেব ওই মতবাদেরই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তদুপরি চৈতন্যদেবের মতো উদার প্রকৃতিবান ব্যক্তির পক্ষে হজরত মুহম্মদকে অন্যতম মহাপুরুষ বা পয়গম্বররূপেও স্বীকার করে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বস্তুত সে যুগে এবং এ যুগেও বহু হিন্দু সজ্জন মহাপুরুষ মুহম্মদকে আল্লার প্রেরিত পুরুষরূপে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
দ্বিতীয় ঘটনা, কাজি কর্তৃক সংকীর্তন বন্ধ করা নিয়ে। কথিত আছে, সেবারেও তিনি যুক্তিতর্কে কাজিকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। পূর্বের অনুমান এস্থলেও প্রযোজ্য।
কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার, এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।
তবুও এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
এযাবৎ আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে, বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এদেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ, পণ্ডিত, দার্শনিকরা কণামাত্র লাভবান হননি। এবং বিদেশাগত পণ্ডিত দার্শনিক এদেশে এসেছিলেন একমাত্র অর্থলাভের উদ্দেশ্যে কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর এদের অধিকাংশ তাদের চরম নিমকহারামির পরিচয় দিয়েছেন পঞ্চমুখে এদেশের নিন্দাবাদ করে। নিন্দা করেছেন মুসলমান রাজা এবং আমির-ওমরাহেরই হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাদের কোনও যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।
ফারসি সাহিত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্রাউন উপরে উল্লিখিত যুগকে ফারসি সাহিত্যের ইন্ডিয়ান সামার পুনরুচ্ছলিত যৌবন নাম দিয়েছেন। বস্তুত বর্বর মঙ্গোল অভিযানের ফলস্বরূপ ফারসি সাহিত্যের যে অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল সে তখন অন্নজল পায় মোগল-দরবারে। ইরান আজকের দিনে ভারতের কাছে কতখানি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছয় না, কিন্তু ভারতবর্ষে ফারসি সাহিত্যের এই যুগ নিয়ে অতি অল্প আলোচনাই হয়েছে, তা-ও উর্দুতে, বাঙলাতে কিছুই হয়নি।
এ তো প্রধানত সাহিত্য ও অন্যান্য বাজয়ের কথা, কিন্তু আমাদের কাছে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বলে মনে হয় এই দেখে যে, ভুবনবিখ্যাত ষড়দর্শনের দেশের লোক মুসলমান মারফতে তো-আরিস্ততল, সিনা-রুশদ নিয়ে সপ্তম দর্শন নির্মাণ করল না। কল্পনা করতে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হয়– ভারতবর্ষ তা হলে দর্শনের ক্ষেত্রে কত না দিচক্রবাল উত্তীর্ণ হয়ে যেত– দেকার্ত-কান্টের অগ্রগামী পথপ্রদর্শক এদেশেই জন্মাতেন!