আজকাল এদেশে অনেকেই ফরাসি শিখছেন। উপরের দুখানা মূল গ্রন্থ ও বাঙলা বইখানা নিয়ে আলোচনা হলে বাঙলা সাহিত্য উপকৃত হবে।
————
১. অনেকেরই বিশ্বাস, যেহেতু মপাসাঁ মেয়েদের ইটানেল হাট বলেছেন তাই পুরুষদের তিনি খুব সম্মানের চোখে দেখতেন। বস্তৃত বে আমি পড়ার পর পুৰুষকুলকেও ইটার্নেল জিগলো (পুং বেশ্যা) বলা যেতে পারে। তবে যৌনক্ষুধাতুর মপাস স্বভাবতই মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বেশি এবং তাদের সম্বন্ধে লিখেছেন বেশি।
২. লেসকফের একটি দীর্ঘ গল্প আমি অনুবাদ করেছি, বিশ্বসাহিত্য এ গল্পটি অতুলনীয় বলে– যদিও আমি পাঁচটা বাবদের ন্যায় এটাতেও অক্ষম। একাধিক গুণীকে অনুরোধ করার পরও তারা যখন সেটি অবহেলা করলেন, তখন বাধ্য হয়ে আমাকেই করতে হল। প্রেম নামে প্রকাশিত হয়েছে।
৩. মপাসাঁর এই প্রবন্ধটি আমি অনুবাদ করি একই সময়ে পচাত্তর বত্সরের পরব উপলক্ষে।
৪-৫. এই দুটি ছত্র ক্যাপিটাল অক্ষরে।
বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি
আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তা হলে এদেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কি না সে নিয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান আগমনের পরও প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাদের ব্রহ্মোওর-দেবোত্তর জমিজমার উপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দীভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনী সঞ্চালনা করেছেন।(১) অল্পোপনিষদ জাতীয় দু-চারখানা পুস্তক নিতান্তই প্রক্ষিপ্ত। বরঞ্চ এরা সত্যানুসন্ধানকারীকে পথভ্রষ্ট করে।
এ এক চরম পরম বিস্ময়ের বস্তু। দশম, একাদশ শতাব্দীতে গজনির মাহমুদ বাদশার সভাপতি আবু-র-রইহান মুহম্মদ অলবিরুনি ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তার প্রামাণিক পুস্তকে একাধিকবার সবিনয়ে বলেছেন, আমরা (অর্থাৎ আরবিতে) যারা জ্ঞানচর্চা করি, দার্শনিক চিন্তা আমাদের মজ্জাগত নয়। দর্শন নির্মাণ করতে পারে একমাত্র গ্রিক ও ভারতীয়েরা।
সেই ষড়দর্শননির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর সাত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুম্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ওই সাত শত বৎসর ধরে যে আরবিতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতিনিজম তথা কিন্দি, ফারাবি, বু আলি সিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল-গজ্জালি(২) (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রুশদ (লাতিনে আসে ) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চা হল তার কোনও সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলি করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান তো-আরিস্ততলের দর্শনচর্চায় সোৎসাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুম্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনিও জানতে পেলেন না যে, তিনি প্রাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুম্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি শুলাভ নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডন করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমার্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবি অনুবাদে পুষ্ট বু আলি সিনার চিকিৎসাশাস্ত্র য়ুনানী নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রিক (আইওনিয়ান= যুনানী চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর) আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান-বাদশার চিকিৎসার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে। সিনা উল্লিখিত যে-ভেষজ কী, তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কিংবা সিনা বলেছেন, ফলানা ওষধিবনস্পতি এদেশে (অর্থাৎ আরবে) জন্মে না, সেগুলো যে তার বাড়ির পিছনের আঁস্তাকুড়ে গজাচ্ছে তারও সন্ধান তিনি পেলেন না। কিঞ্চিৎ কল্পনাবিলাস করলে, এ পরিস্থিতিও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে, মৌলানার বেগমসায়েবা সিনা-উল্লিখিত কোন শাক তাকে পাক করে খাওয়ালেন, আর তিনি সেটি চিনতেই পারলেন না।
পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এই দুস্তর মরুভূমির মাঝখানে মাত্র একটি লোক দেখতে পাই। আওরঙ্গজেবের অগ্রজ যুবরাজ মুহম্মদ দারাশিকুহু। ইনিই সর্বপ্রথম দুই ধর্মের সমন্বয় সম্বন্ধে বহুতর পুস্তক লেখেন। তার অন্যতম মজমা-উল-বহরেন, অর্থাৎ দিসিন্ধুসঙ্গম। দারাশিকুহু বহু বৎসর অনাদৃত থাকার পর তার সম্বন্ধে প্রামাণিক গবেষণা বিশ্বভারতীতেই হয়। শ্ৰীযুক্ত বিক্রমজিৎ ইসরৎ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে দারাশিকু : লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক নামক একখানি অত্যুত্তম গ্রন্থ লেখেন এবং বিশ্বভারতী কর্তৃক সেটি প্রকাশিত হয়। প্রয়োজনমতো আমরা এই পুস্তকখানি সদ্ব্যবহার করব।
আরও তিন শত বৎসর পর প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন রায় ফারসিতে রচনা করেন তার সর্বপ্রথম পুস্তক, তুইফতু অল-মুওয়াহহিদিন : একেশ্বরবাদীদের প্রতি উৎসর্গ। রাজা খ্রিস্টধর্মের সঙ্গেও সুপরিচিত ছিলেন বলে তার পুস্তককে ত্রিরত্নধারী বা ত্রিপিটক বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্রাহ্মধর্মের উৎপত্তি সম্বন্ধে যারা সামান্যতম অনুসন্ধান করেছেন তারাই জানেন রাজার শিক্ষাদীক্ষা ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির নিকট কতখানি ঋণী এবং পরবর্তী জীবনে যদিও তিনি উপনিষদের ওপর তার ধর্মসংস্কারসৌধের দৃঢ়ভূমি নির্মাণ করেছিলেন তবু শেষদিন পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধার কণামাত্র হ্রাস পায়নি। প্রয়োজনমতো আমরা তার রচনাবলিরও সদ্ব্যবহার করব।