শুধু তাই নয়, সেই শ্রদ্ধার নির্লজ্জ উচ্ছ্বাস পাঠক পাবেন ফ্রোবের ও তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে লিখিত মোসর প্রবন্ধে।
তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে লেখা তার প্রবন্ধটি অন্য দেশ কতখানি সম্মান দেয়, আমার জানা নেই। তবে রুশ দেশ তার চরম সম্মান দেয় ও দিয়েছে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তুর্গেনিয়েফের মৃত্যুর পঁচাত্তর বৎসর পূর্ণ হলে সারা রুশদেশব্যাপী তাঁকে স্মরণ করা হয়। সেই উপলক্ষে তুর্গেনিয়েফের ভাইয়ের মেয়ে (কিংবা আপন জারজ, পরে আইনসম্মত কন্যা দেশবাসী কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে তার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি তার প্রবন্ধ আরম্ভ করেন তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে মপাসাঁর প্রশংসাকীর্তন নিয়ে। তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে রুশ দেশ এবং রুশ দেশের বাইরে বিস্তর প্রবন্ধ বের হয়েছে (এবং আশ্চর্য, মপাসাঁ যখন তার খ্যাতির চরমে, যখন তাঁর ছোটগল্প ইয়োরোপের প্রায় সর্ব ভাষায় অনূদিত হচ্ছে তখন তিনি খাতির পাননি এক রুশ দেশে, যদিও রুশ দেশ সবসময়ই ফ্রান্স-পাগল, কারণ রুশে তখন তলস্তয়, তুর্গেনিয়েফ, লেসকফ(২), দস্তয়েস্কি, চেখফ কেউ-বা তাঁর বিজয়শঙ্খ বাজাচ্ছেন বিপুল বিক্রমে, কারও বাণী দূর-দূরান্তরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, কারও-বা মধুর কণ্ঠের প্রথম কাকলি দেশের সর্বত্র নবীন চাঞ্চল্য জাগিয়ে তুলেছে- মপাসাঁকে লক্ষ করার ফুর্সং তাদের নেই) কিন্তু ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তুর্গেনিয়ে পরিবারের প্রতিভূ স্মরণ করলেন মাপাসাঁকে সেই মপাসাঁ যার প্রবন্ধ পৃথিবীর সর্বত্র পরিচিত।(৩)
তাই বলছিলুম, মপাসাঁর নির্লজ্জ উচ্ছ্বাস পাঠক পাবেন এ দুটি প্রবন্ধে এবং তার অন্যান্য রচনায়। মানুষ মপাসাঁকে চেনবার ওই একমাত্র উপায়। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা মপাসাঁ বন্ধুদের সঙ্গে তো করতেনই না, লেখাতে যা করেছেন তা-ও পঞ্চাশ লাইনের বেশি হয় কি না হয়।
আর আছে তার চিঠি। কিন্তু সেগুলোতে তিনি তার হৃদয়ের গভীর ব্যথা, তার আশা-আকাক্ষা সম্বন্ধে নীরব। তার কারণ গুরু ফ্লোবের কর্তৃক জর্জ সানডকে লেখা তার অন্তরঙ্গ চিঠি যখন ছাপাতে প্রকাশিত হয়, তখন ফ্রান্সের মতো দেশেও তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। মপাসাঁ তখনই সাবধান হয়ে যান। পারলে মপাসাঁ ফ্লোবেরের চিঠিগুলো প্রকাশিত হতে দিতেন না। শেষটায় যখন দেখলেন প্রকাশ হবেই হবে তখন মপাস সে সংকলনের ভূমিকা লিখতে রাজি হন। তিনি আশা করেছিলেন গুরুর পদতলে তাঁর শ্রদ্ধা অর্ঘ্য নিবেদন দেশের পাঁচজনকে বুঝিয়ে দেবে, ফ্লোবেরকে কোন পরিপ্রেক্ষিতে দেখে তার সত্য মূল্য দিতে হয়।
তবুও মপাসাঁর চিঠিগুলো যে অমূল্য, তুলনাহীন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমার জানা মতে তার সর্বশেষ চিঠি তার ডাক্তারকে লেখা এইটি সর্বশেষ না হলেও এটিতে পাঠক পাবেন রাজহংসের মরণগীতি।
তার চিকিৎসক ডাক্তার আঁরি কাজালি (জালাওর)-কে লিখিত,
কান, ইজের কুটির।
আমি একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছি। তারও বেশি। আমি এখন মৃত্যুর শেষ যন্ত্রণায়। নাকের ভিতর নোনা জল ঢেলে সেটা ধুয়েছিলাম বলে তারই ফলে আমার মগজ নরম হয়ে গিয়েছে। সেই নুন মাথার ভিতর গাঁজিয়ে ওঠায় (ফের্মাতাসিয়ে– ফার্মেন্টশন) সমস্ত রাত ধরে আমার মগজ গলে গিয়ে চ্যাটচেটে পেস্টের মতো নাক আর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে। এ হচ্ছে আসন্ন মৃত্যু, আর আমি উন্মাদ।(৪) আমি প্রলাপ বকছি। শেষ-বিদায় বন্ধু, বিদায়! তুমি আমাকে আবার দেখতে পাবে না…(৫)
আমি ডাক্তার নই, তাই বলতে পারব না, মানুষের জীবিতাবস্থায় কিংবা মৃত্যুর পরও তার নাক কান দিয়ে মগজ গলে বেরোয় কি না, নুনের ফার্মেন্টেশন হয় কি না তা-ও জানিনে। স্পষ্টত এ চিঠি উন্মাদের প্রলাপ। কিন্তু প্রশ্ন, উন্মাদ কি স্বীকার করে সে প্রলাপ বকছে?
***
ফরাসি ভাষায় মপাসাঁর দু-খানি অত্যুত্তম রচনা ও পত্রসংগ্রহ আছে। ইংরেজিতে এগুলোর অনুবাদ হয়েছে কি না জানিনে।
(১) CHRONIQUES, ETUDES, CORRESPONDANCE
DE GUY DE MAUPASSANT
Recueillies Prefacees et Annotees par
RENE DUMESNIL
avec la collaboration de Jean Loize
et publiees pour la premiere fois avec nombreux
DOCUMENTS INEDITS
LIBRAIRIE GRUEND, 60, RUE MAZARINE. 60,
PARIS, VI, 1938
(২) CORRESPONDANCE INEDITE
DE
GUY DE MAUPASSANT
Recueihie et presentee
ARTINE ARTINIAN
avec la collaboration d
EDOURAD MAYNIAL
Editions Dominique Wapler,
6, Rue de Londres,
Paris, 1951
বছর কুড়ি পূর্বে একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকা নানা দেশের চুয়াত্তর জন খ্যাতনামা লেখককে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, কোন কোন লেখক তাদের সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। উত্তরে মপাসাঁ- জর্মন কবি হাইনে, এবং হোমার হুইটমানের সমান সম্মান পান এবং ইবসেন ও তাঁদালের চেয়ে বেশি।
এদেশেও মপাসাঁ নিয়ে কৌতূহল আছে। কয়েকদিন পূর্বে শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক অধুনা লিখিত সাহিত্যিকদের জীবনী সম্বলিত সাহিত্যালোচনার একখানা অত্যুত্তম পুস্তক আমার হাতে এসে পৌঁছল। সোনার আলপনা (এভারেস্ট বুক হাউজ, ১৯৬০)।
বইখানিতে অন্যান্য মনোরম প্রবন্ধের ভিতর গি দ্য মপাস ও ইভান তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধেও দুটি রচনা রয়েছে।