তিনজনই কপর্দকহীন, তিনজনই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন আপন আপন যশ ও চরিত্রবল। প্রথম দুজনার স্বজাতি ছিল উত্তর আফ্রিকায়, অথচ শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এদের কেউই কোনও সৈন্যবাহিনী গঠন করে তুনিসিয়া আলজারিয়ায় লড়তে পারলেন না; শুধু তাই নয়, জর্মন রমেল যখন উত্তর আফ্রিকায় বিজয় অভিযানে বেরুলেন তখন এদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবারও প্রয়োজন অনুভব করলেন না। এদের কেউই জর্মন সরকারকে আপন ব্যক্তিত্ব দিয়ে অভিভূত করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তাদের গতি হল আর পাঁচজনের মতো ইতালি থেকে বেতারে আরবিতে বক্তৃতা দিয়ে প্রোপাগান্ডা করার।
অথচ, পশ্য, পশ্য সুভাষচন্দ্র কী অলৌকিক কর্ম সমাধান করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ করে, ইংরেজের গর্ব ভারতীয় সৈন্যদের এক করে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে তিনি ভারতবর্ষ আক্রমণ করলেন। বর্মা-মালয়ের হাজার হাজার ভারতীয় সর্বস্ব তার হাতে তুলে দিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেল!
আমরা জানি, জাপান চেয়েছিল, সুভাষচন্দ্র ও তার সৈন্যগণ যেন জাপানি ঝাণ্ডার নিচে দাঁড়িয়ে লড়েন (মুফতি এবং আবদুর রশিদ জর্মনিকে সে সুযোগ দিতে বাধ্য করাতে পারেননি)। ভাষচন্দ্র কবুল জবাব দিয়ে বলেছিলেন, আমি আজাদ হিন্দ ও তার ফৌজের নেতা। আমার রাষ্ট্র নির্বাসনে বটে, কিন্তু সে রাষ্ট্র স্বাধীন এবং সার্বভৌম। যদি চাও তবে সে রাষ্ট্রকে স্বীকার করার গৌরব তোমরা অর্জন করতে পার। যদি ইচ্ছা হয় তবে অস্ত্রশস্ত্র এবং অর্থ দিতে পার– এক স্বাধীন রাষ্ট্র যেরকম অন্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে মিত্রভাবে ধার দেয়, কিন্তু আমি কোনও ভিক্ষা চাই না এবং আমার সৈন্যগণ আজাদ হিন্দ ভিন্ন অন্য কোনও রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে যুদ্ধ করবে না।
আজ আমরা স্বাধীন। পৃথিবীতে আমাদের গৌরব আজ অনেক বেশি। নেতাজি বিনাশর্তে সেদিন যে শক্তি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, আজ কি আমরা তা পারব না? না পারলে বুঝতে হবে আমাদের রাজনীতি দেউলিয়া।
পরিচিতি
কিছুদিন পরপরই নতুন করে আলোচনা হয় এখনও লোকে মপাসাঁ পড়ে কি না, পড়লে কারা পড়ে? ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন, রুশ? ফ্রান্সের লোকের কথা বাদ দেওয়া যেতে পারে। তারা অল্পবিস্তর সবসময়ই পড়বে। উপস্থিত শুনতে পাই, মার্কিন দেশেই নাকি তার সবচেয়ে বেশি কদর। যারা এসব আলোচনা করেন তারা প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্যগুলোর সঙ্গে আদৌ পরিচিত নন বলে সেগুলোকে হিসাবেই নেন না। আমার জানামতে আরব দেশে এখনও তার প্রচুর সম্মান; তার অন্যতম কারণ আরবি প্রচলিত মিশর থেকে বাইরুৎ-দামাস্কস পর্যন্ত ফরাসির প্রচলন ইংরেজির তুলনায় বেশি। অধুনা মার্কিন ভাষা ওইসব দেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে, কিন্তু তাতে মোসর কোনও ক্ষতি হবে না; কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, মার্কিনজাত মপাসাঁ-ভক্ত।
তা সে যা-ই হোক, ফ্রান্সের বাইরে কিন্তু তাঁর রচনা (essays) নিয়ে কখনও কোনও আলোচনা হতে দেখিনি। এ যেন অনেকটা কনান ডয়েলের মতো। তার শার্লক হোমস নিয়ে সবাই এমনই মুগ্ধ যে তার অন্যান্য লেখার দিকে কেউই বড় একটা নজর দেন না। শার্লক হোমসে এমনই ঝাল যে তার পর বাকি তাবৎ রান্না অতিশয় সুনিপুণ হলেও ফিকে বলে মনে হয়।
আমার বলার উদ্দেশ্য এ নয় যে, মোসর প্রবন্ধ তার ছোটগল্পকে হার মানায়। বস্তৃত তার সর্বোত্তম উপন্যাসদ্বয়ই–য়্যুন ভি এবং বেল আমি(১)– তার ছোটগল্পকে হার মানাতে পারেনি।
তার নাট্য ও কবিতাও নিম্নাঙ্গের। পক্ষান্তরে চেখফ ছোটগল্প এবং নাটক, উভয়েই অদ্বিতীয়।
আমার নিজের মনে হয়, মপাসাঁর প্রবন্ধগুলো অত্যুত্তম। তার গুরু ফ্লোবের ও গুরুসম– ফ্লোবেরের অন্তরঙ্গ বন্ধু– তুর্গেনিয়েফ সম্বন্ধে তিনি যে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলো অতুলনীয়। মপাসাঁর ছোটগল্প বা উপন্যাসে পাঠক পাবেন দেহ ও যৌবন ক্ষুধার ছড়াছড়ি কিন্তু সত্যকার প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা, কিংবা সে শ্রদ্ধার প্রতি সহানুভূতি, অথবা স্নেহের প্রতি অনুরাগ, মানুষের এসব তাবৎ মহামূল্যবান বৈভবের প্রতি মপাসাঁর কোনও আকর্ষণ নেই। তিনি যা চান তাই ফুটিয়ে তুলতে পারেন বলে যখন এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন তখন সেগুলো প্রকাশ করেছেন তার যাদুকাঠির পরশ দিয়েই কিন্তু তখন তাঁর উদ্দেশ্য অন্য, ওইসব বৈভবকে সম্মান দেখানো নয়, ওগুলো ব্যবহার করা হয়েছে যেন প্যাডিংরূপে। অথচ আমরা জানি মপাসাঁ তার মাকে ভালোবাসতেন গভীর রূপে বস্তুত এরকম মাতৃভক্ত পুত্র সর্বকালেই সর্বদেশেই বিরল– যে-লোক প্রতিদিন ভালো-মন্দ-মাঝারি, ডাচেস থেকে স্বৈরিণী পর্যন্ত বিচরণ করে, আপন ফুর্তির জন্য কাড়া কাঁড়া টাকা ছড়ায়, হেন দুষ্কর্ম নেই যা তার অজানা এবং যার জন্য সে পয়সা খর্চা করতে রাজি নয়– সেই লোক ঠিক নিয়মিতমাকে মোটা টাকা পাঠায়, নিয়মিত মধুর চিঠি লেখে, পাছে মা টের পেয়ে যান তাই অতিশয় অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রাচীন প্রথামত নববর্ষের পরব রাখতে গায়ে মায়ের বাড়িতে যায় (তার পাঁচ দিন পরই তার মাথার ব্যামো- সিফিলিসজনিত উন্মাদরোগ তাকে এমনি বিভ্রান্ত করে যে তিনি ছুরি দিয়ে গলা কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা দেন; অনুগত ভৃত্য ফ্রাসোয়া পিস্তলের গুলি আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় সরিয়ে রেখেছিল), সে যে শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্মান দিত না, এ তো হতেই পারে না।