অবশ্য তারচেয়েও বড় গাড়োল, যে টাকার জন্য লিখেও টাকা কামাতে পারল না।
আমি ড. জনসনের পদধূলি হওয়ার মতোও স্পর্ধা ধরিনে; অতএব তাঁর মতো কটুভাষা ব্যবহার না করে, অর্থাৎ কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখে, সেই অনুযায়ী কে পাঠা, কে গোলাপফুল সে আলোচনা না করে শুধু বলব আমি স্বয়ং লিখেছি, নিছক টাকার জন্য।
আমার বয়স যখন উনিশটাক তখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আমাকে একদিন বললেন, এবার থেকে তুই লেখা ছাপাতে আরম্ভ কর। আর দেখ, লেখাগুলো আমাকে দিয়ে যাস। আমি ব্যবস্থা করব।
আমার অর্থাভাব তিনি জানতেন; তদুপরি আমার হাত দিয়ে কেউ যেন তামাক না খায়, অর্থাৎ আমাকে exploit না করে। তিনি একদা উত্তমরূপেই জমিদারি চালিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যাচ্ছিল তাই বান্দেবীকে বানরীর মতো ঘাগরা পরিয়ে ঘরে ঘরে নাচতে হল না (এটি বিদ্যাসাগর মশাই দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, অস্য দগ্ধ উদরস্যার্থে কিং কিং ন ক্রিয়তে ময়া। বানরীমিব বান্দেবীং নয়ামি গৃহে গৃহে ॥)।
আমি শান্তিনিকেতন ছাড়ি ১৯২৬-এ। ১৯৩৮-এ গুরুদেবকে প্রণাম করতে এলে তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোনও লেখা ছাপাচ্ছি না কেন? উত্তরে কী বলেছিলুম সেটা আর এখানে বলে কাজ নেই।
কায়ক্লেশে চলে গেল ১৯৪৯ পর্যন্ত। লঙ্গরখানা (অর্থাৎ ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্ট-মসৃজিদে) বন্ধ হয়ে গেল তখন; যেটা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও পৃথিবীতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অপরা কম্পজিস্ট রসসিনি বলতেন, আমি ছেলেবেলা থেকেই জানতুম, অর্থের প্রয়োজন আছে। কিন্তু দেখলুম, এক অরা কম্পোজ করা ভিন্ন অন্য কোনও এলেম আমার পেটে নেই। সেই করে টাকা হয়েছে যথেষ্ট। এখন আর কম্পোজ করব কোন দুঃখে! খ্যাতির মধ্যগগনে, যৌবনে, তিনি এই আপ্তবাক্যটি ছাড়েন। তার পর তিনি বোধহয় আরও দুটি অপূরা তৈরি করেন একবার নিতান্ত বাধ্য হয়ে, প্রায় প্রাণ বাঁচানোর জন্য, ও আরেকবার একজনকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য।
রসসিনির তুলনায় আমি কীটস্য কীট। কিন্তু আমি দেখলুম, ওই এক বই লেখা ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে পয়সা কামাবার মতো বিদ্যে আমার ব্রেন-বাক্সে নেই। আশ্চর্য, তার পর একটা চাকরি পেয়ে গেলুম। কাজেই লেখা বন্ধ করে দিলুম। চাকরি ইস্তফা দিলুম। ফের কলম ধরতে হল। ফের চাকরি। ফের কলম। ফের চাকরি, ফের- ইত্যাদি।
আমার লেখা অল্প লোকেই পড়েন, আমার জীবন এমন কিছু একটা নয় যা নিয়ে লোকের কৌতূহল থাকতে পারে। তবু যারা নিতান্তই নোজি (পিপিং টম–নোজি পার্কার) তারা লক্ষ করে থাকবেন, যখন আমার চাকরি থাকে, তখন আমি লিখি না।
একবার ফ্রান্সে ঢোকবার ফর্মে প্রশ্ন ছিল–তোমার জীবিকা নির্বাহের উপায় কী?
উত্তরে লিখেছিলুম, কিছুদিন অন্তর অন্তর চাকরি রিজাইন দেওয়া (রিজাইনিং জ ফ্রম টাইম টু টাইম্)।
ফরাসি শুধোল, তা হলে চলে কী করে?
বললুম, তুমি রেজিগনেশনগুলো দেখছ; আমি জবগুলো দেখছি।
পেটের দায়ে লিখেছি মশাই, পেটের দায়ে। বাংলা কথা স্বেচ্ছায় না লেখার কারণ—
(১) আমার লিখতে ভালো লাগে না। আমি লিখে আনন্দ পাইনে।
(২) এমন কোনও গভীর, গূঢ় সত্য জানি নে যা না বললে বঙ্গভূমি কোনও এক মহাবৈভব থেকে বঞ্চিত হবেন।
(৩) আমি সোশ্যাল রিফর্মার বা প্রফেট নই যে দেশের উন্নতির জন্য বই লিখব।
(৪) খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কি না, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোন্ড ব্লাডেড, যেরকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয় অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কি না?–শবুনমের সঙ্গে আমার আবার দেখা হল কি না, চাচাটি কে, আমি আমার বউকে ডরাই কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মতো খাটাশটাকেও একনজর দেখে নিতে চান। কারণ কলকাতায় ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতোমধ্যে আর কী করা যায়। এবং এসে রীতিমতো হতাশ হন। ভেবেছিলেন দেখবেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো সুপুরুষ সৌম্যদর্শন নাতিবৃদ্ধ এক ভদ্রজন লীলাকমল হাতে নিয়ে সুদূর মেঘের পানে তাকিয়ে আছেন; দেখেন বাধিপোতার গামছা পরা, উত্তমার্ধ অনাবৃত, বক্ষে ভালুকের মতো লোম, মাথা-জোড়া-টাক ঘনকৃষ্ণ ছাড়া ছ্যাবড়া রঙ, সাত দিন খেউরি হয়নি বলে মুখটি কদমফুল হাতলভাঙা পেয়ালায় করে চা খাচ্ছে আর বিড়ি ফুকছে!
আমি রীতিমতো নোটিশ দিয়ে লেখা বন্ধ করেছি। গত বৎসর মে মাসে আমি দেশ পত্রিকা মারফৎ সেটা জানিয়ে দিয়েছিলুম। কেউ কেউ আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন– তাদের স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। তার পরও দু-একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দাদন শোধের জন্য।
আর কখনও লিখব না, একথা বলছি না। চাকরি গেলেই লিখব। খেতে পরতে তো হবে।
নেতাজি
আজ– এবং নেতাজি
এ পৃথিবীতে ভারতের মতো অতখানি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর নেই। এবং সে জন্য যে আমরা ক্যাপিটালিস্ট-কম্যুনিস্ট উভয়পক্ষেরই বিরাগভাজন হয়েছি তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। সামাজিক জীবন লক্ষ করলেই এ তত্ত্বটা পরিষ্কার হয়ে যায়। যে মানুষ দলাদলির মাঝখানে যেতে চায় না–তা সে স্বভাবে শান্তিপ্রিয় বলেই হোক, আর দুই দলের গোঁড়ামিই তার কাছে আপত্তিকর বলে মনে হয় বলেই তোক সে উভয় দলেরই গালাগালি খায়।