তার পর এক দিন বাহিরিবে তপঃ সাঙ্গ হলে
শৃঙ্খল হবে মুক্ত– এ প্রলয় অভিজ্ঞতা বলে
হবে না তো উচ্ছল; অচঞ্চল দৃঢ় পদক্ষেপে
সমাহিত, রিপু শান্ত, স্বর্গ মর্ত্য ত্রিভুবন ব্যেপে
চলিবে হে ত্রিবিক্রম। পরিবে দুর্জয় বরমালা
পূত শান্তি মিষ্ণু পূণ্য সর্ব-বিশ্ব-প্রেম গন্ধ ঢালা ॥*
২৫/১১/১৯৪৫
———-
* দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জয়লাভের পর ইংরেজ সরকার যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনানীদের লালকেল্লায় বিচার শুরু করে, তখন তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। শাহনওয়াজ-ধীলন-ভোঁসলে দিবসে বাংলার তরুণসমাজ কলকাতায় সেদিন যে সম্পূর্ণ অহিংস প্রতিবাদ আন্দোলনের পরাকাষ্ঠা দেখান তার তুলনা বিরল। অথচ সেই অহিংস আন্দোলনকারীদের ওপর ইংরেজ পুলিশ গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি। এই গুলিবর্ষণের ফলে রামেশ্বর নামে একটি তরুণ ছাত্র নিহত হন। সেদিনের ঘটনার পটভূমিকায় এই কবিতা লিখিত হয়।
দরখাস্ত
এইমাত্র কয়েকদিন পূর্বে ঘটনাটি ঘটেছে। আমার এক বন্ধুপুত্র ঝাড়া তেরোটি বচ্ছর কাজ করার পর মিন্ নোটিশে চাকরি হারাল। টাইপ-করা একখানা কাগজ হাতে তুলে দিল, তার সারমর্ম–তোমাকে দিয়ে আমাদের আর কোনও প্রয়োজন নেই, কেটে পড়।
চৌদ্দ বছর পর চাকরি গেলে খুব আশ্চর্য হতুম না। কারণ আজকাল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর অর্থ চোদ্দ বছর। তার পর মুক্তি। ঠিক সেইরকম আমার এক ফরাসি-বন্ধু তার সিলভার ওয়েডিঙের প্রবে আমায় শুধোলেন, আমাদের দেশে, জেলে ম্যাক্সিমাম ক বছর পুরে রাখে? আমি ওই উত্তর দিলে তিনি বললেন, তবে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন?
আমি শুধালুম, কিসের থেকে?
কড়ে আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে বউকে দেখিয়ে বললেন, ওই যে, ওর সঙ্গে পঁচিশটি বৎসর বন্দি হয়ে কাটালুম। এখনও কি মুক্তি পাব না?
উল্টোটাও শুনেছি। এক ইংরেজকে শুধিয়েছিলুম নিজে বিয়ে করতে যাবার ঠিক আগের দিন ওদের বিবাহিত জীবনের কাহিনী শোনাতে। বললেন, বিয়ের চোদ্দ বছর পর একদিন বউকে একটুখানি সামান্য কড়া কথা বলতেই সে ডান রুটি একটু উপরের দিকে তুলে শুধোল, ডার্লিং! তবে কি আমাদের হানিমুন শেষ হয়ে গেল? ইংরেজ একটু থেমে বললেন, ওই আমার আক্কেল হয়ে গেল। এর পর আর কখনও রা-টি পর্যন্ত কাড়িনি। তারই কিছুদিন পর তার যমজ সন্তান হলে পর আমি তাকে বলেছিলুম, চীনা ভাষায় প্রবাদ আছে যে লোক মোমবাতির খর্চা বাঁচাবার জন্য সন্ধ্যার সময়েই শুয়ে পড়ে তার যমজ সন্তান হয়। ইংরেজ সেয়ানা; সঙ্গে সঙ্গে সক্কলকে একটা রাউন্ড খাইয়ে দিলে।
এ বাবদে আমাকে লাখ কথার সেরা কথা শুনিয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রপতি-তখন অবশ্য তিনি কাশীতে সাদামাটা অধ্যাপক জুলুদের অভিধানে নাকি স্বামীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এক প্রকার জংলি পশু যাকে স্ত্রী পোষ মানায়।
এবং দুই এক্সট্রিম সদাই মিলে যায় বলে অভিজাত চীনাদের অভিধানে লেখকের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, একপ্রকারের বন্যজন্তু যাকে সম্পাদক পোষ মানায়।
গেল চৌদ্দটি বছর ধরে বঙ্গদেশের সম্পাদক তথা প্রকাশককুল আমাকে পোষ মানাবার চেষ্টা করেছেন। আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন তারা আর আমাকে ছাড়তে চান না। উত্তম শায়েস্তাপ্রাপ্ত কয়েদিকে জেলার ছাড়তে চায় না। বাড়ির এড়া-সেডা করে দেয় অথচ তাকে মাইনে দিতে হয় না।
আমি কিন্তু মহারানির কাছে আপিল করেছি– চোদ্দ বছর পূর্বে ঠিক ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আমার প্রথম বই বেরোয়। আজ ১৯৬৪, আমার ছুটি মঞ্জুর হোক।
কুকর্ম করে মানুষ জেলে যায়। আমিও কুমতলব নিয়ে লেখক হয়েছিলুম।
সাধারণের বিশ্বাস, লেখকের কর্তব্য পাঠককে পরিচিত করে দেবে বৃহত্তর চিন্তাজগতের সঙ্গে, তাকে উদ্বুদ্ধ করবে মহান আদর্শের পানে, প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক জেরোম কে জেরোমের ভাষায়, তাকে এলিভেট করবে। এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন, মাই বুক উইল নট এলিভেট ইভন এ কাউ!
লেখকের কর্তব্য যদি পাঠককে মহত্তর করে ভোলাই হয়, তবে নিঃসন্দেহে কুমতলব নিয়েই আমি সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলুম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ লাভ।
মহাকবি হাইনে একাধিকবার বলেছেন– তাই তাকে একাধিকবার উদ্ধৃত করতে আপত্তি নেই– কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই বুঝেছি। আমার বেলা তারচেয়েও সরেস। আমার হাতে অর্থ কখনওই আসেনি। কাজেই মূল্য বোঝা-না-বোঝার কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। আমি চিরটাকাল খেয়েছি লঙ্গরখানায়, ঘুমিয়েছি মসজিদে; কাজেই বছরটা আঠারো মাসে যাচ্ছিল।
এমন সময় লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে যিনি পুষতেন তিনি আল্লার ডাক শুনে ওপারে চলে গেলেন। বেহেশতে গিয়েছেন নিশ্চয়ই; কারণ আমাকে নাহক পোষা ছাড়া অন্য কোনও অপকর্ম (গুনাহ্) তিনি করেননি।
মাত্র কিছুদিন পূর্বে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে বেরিয়েছে ফ্লেমিঙের মত্যর পর তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে যাতে আছে আনঅ্যাশেমডলি আই অ্যাডমিট আই রাইট ফর মানি।
এর পর যেসব পূর্বসূরিগণ নিছক অর্থের জন্যই লিখনবৃত্তি গ্রহণ করেন, তাঁদের নাম করতে গিয়ে বাজা, ডিকেন্স, টু, ট্রলোপের নাম করেছেন।
এই প্রবন্ধটির উদ্ধৃতি দিয়েছেন মি. কাউলি। তিনি তার পর আপন মন্তব্য জুড়েছেন, কিন্তু এখানে, থেমে যাওয়া কেন?বওয়েলের লেখা যারা স্মরণে রাখেন তারাই মনে করতে পারবেন, ড, জনসনও এ-বাবদে কুহকাচ্ছন্ন ছিলেন না, নিতান্ত গাড়োল (blockhead) ভিন্ন অন্য কেউ অর্থ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লেখে না–এই ছিল সেই মহাপুরুষের সুচিন্তিত অভিমত।