(২) চাকরি যেখানে ব্যক্তিবিশেষ কিংবা ব্যবসাবিশেষের চাকরি, সেখানে সে চাকরির মূল্য চাকুরের পক্ষে যথেষ্ট কিন্তু দেশের পক্ষে তা যৎসামান্য। কিন্তু চাকরি যখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হয়, তখন তার গুরুত্ব অসাধারণ। সকলেই জানেন, দেশের শ্রীবৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মুখে অনেকগুলি বিরাট বিরাট পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পরিকল্পনা ফলবতী করার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত বর্তায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ওপর।
তাই প্রশ্ন, এইসব চাকরি পাচ্ছে কজন বাঙালি? পূর্বের তুলনায় এদের উপস্থিত রেশিয়া কী? পূর্বের তুলনা বাদ দিলেও, প্রাদেশিক জনসংখ্যার হিসাবে তারা তাদের ন্যায্য হক্কগত রেশিয়ো পাচ্ছে কি?
দিল্লিবাসী বাঙালিমাত্রই একবাক্যে তারস্বরে বলবেন, না, না, না। পরশ্রীকাতর অবাঙালিও সে ঐক্যতানে যোগ দেয়। মনে মনে হয়তো বলেন, ভালোই হয়েছে। তা সেকথা থাক।
কেন পায়নি তার জন্য আমি কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষ দেব না। দোষ বাঙালির। কেন পারল না, সে সাফাই গাইবার জন্যই এ আলোচনা। একটু ধৈর্য ধরুন।
(৩) অথচ দ্রষ্টব্য, দিল্লির সাংস্কৃতিক মজলিশে বাঙালি এখনও তার আসন বজায় রাখতে পেরেছে। এই কিছুদিন পূর্বেই শম্ভু মিত্র দিল্লিতে যা ভেল্কিবাজি দেখালেন সে কেরামতি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। অল্পের ভেতর লিটল থিয়েটার চালায় চাটুয্যে। দিল্লিতে যাবতীয় চিত্রভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় বাঙালি উকিলবাবুর তাঁবেতে। গানাবাজনাতে বাঙাল আলাউদ্দিন সায়েব– রবিশঙ্করের কথা নাই-বা তুললুম। শিক্ষাদীক্ষায় মৌলানা আজাদ সায়েব। সাহিত্যে হুমায়ুন কবির।
ইতোমধ্যে সত্যজিৎ রায়ের ভোলা পথের পাঁচালী দিল্লি ছাড়িয়েও কহাঁ কঁহা মুলুকে চলে গিয়েছে। নভেম্বরে বুদ্ধ-জয়ন্তী হওয়ার পূর্বেই হাকডাক পড়ে গিয়েছে, কে করে তবে নটীর পূজা, কাকে ডাকা যায় চণ্ডালিকার জন্য?
অর্থাৎ বাঙালির রসবোধ আছে, অর্থাৎ স্পর্শকাতর। তাই সে সেনসিটিভ এবং অভিমানী।
আলিপুর বোমা হামলার সময় শমসুল হক (কিংবা ইসলাম) নামক একজন ইন্সপেক্টর আসামিদের সঙ্গে পিরিত জমিয়ে ভেতরের কথা বের করে ফাস করে দেয়। বোমারুরা তাই তার উল্লেখ করে বলত, হে শমসুল, তুমিই আমাদের শ্যাম, আর তুমিই আমাদের শূল।
স্পর্শকাতরতাই বাঙালির শ্যাম এবং ওই স্পর্শকাতরতাই তার শূল। শুধুমাত্র কিছু না দিয়ে স্টেজ সাজিয়ে নিয়ে দশটা বাঙালি তিন দিনের ভেতর যেরকম একটা নাট্য খাড়া করে দিতে পারে, অন্য প্রদেশের লোক সেরকম পারে না। আবার যেখানে পাঁচটা সিন্ধি পারমিটের জন্য বড় সায়েবের দরজায় পঞ্চান্ন দিন ধন্না দেবে সেখানে বাঙালির নাভিশ্বাস ওঠে পাঁচ মিনিটেই। সংসার করে খেতে হলে ড্রিল-ডিসিপ্লিনের দরকার। আর ওসব জিনিস পারে বুদ্ধিতে যারা কিঞ্চিৎ ভোতা, অনুভব-অনুভূতির বেলায় একটুখানি গণ্ডারের চামড়া-ধারী।
স্পর্শকাতরতা এবং ডিসিপ্লিন এ-দুটোর সময় হয় না? বোধহয় না। লাতিন জাতটা স্পর্শকাতর, তাদের ভেতর ডিসিপ্লিনও কম। ইংরেজ সাহিত্য ছাড়া প্রায় আর সব রসের ক্ষেত্রে ভোঁতা– তাই তার ডিসিপ্লিনও ভালো।
এ আইনের ব্যত্যয় জর্মনিতে। চরম স্পর্শকাতর জাত মোক্ষম ডিসিপ্লিন মেনে নিলে কী মারাত্মক অবস্থা হতে পারে হিটলার তার সর্বোত্তম উদাহরণ। হালের জনরা তাই বলে, অতখানি ডিসিপ্লিন ভালো নয়। কিন্তু একথা কাউকে বলতে শুনিনি, অতখানি স্পর্শকাতরতা ভালো নয়।
কোনও জিনিসেরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়, সে তো আমরা জানি, কিন্তু আসল প্রশ্ন, লাইন টানব কোথায়? জাতীয় জীবনে স্পর্শকাতরতা থাকবে কতখানি আর ডিসিপ্লিন কতখানি? কিংবা শুধাই, উপস্থিত যে মেকদার বা প্রাপৰ্শন আছে সেটাতে বাড়াই কোন বস্তু। স্পর্শকাতরতা না ডিসিপ্লিন?
গুণীরা বিচার করে দেখবেন।
দিল্লি
১৩৬৩
তপঃশান্ত
শাস্ত্র তো মানি না আজ। হে তরুণ, তব পদাঘাত
দেশের তারে দিল কী রূঢ় চেতনা! ঝঞ্ঝাবাত
ঘূর্ণিবায়ু দিগ্বিদিক আন্দোলিয়া কী মহাপ্রলয়
নটেশ তাব্ব-নৃত্য। হে তরুণ! জয়, জয়, জয়
জয় তব; অর্থহীন মূল্যহীন কে বৃথা শুধায়
কোথায় তোমার লক্ষ্য! বন্যা যবে বাঁধ ভেঙে যায়
মিথ্যা প্রশ্ন কোথা তার গতি। হে তরুণ, হে প্লাবন
নহ তো তটিনী। দুকূলের শাস্ত্র মিথ্যা। চিরন্তন,
মৃত্যুঞ্জয়, হে নবীন, তোমার ধমনী রক্তবীণ,
অন্তহীন, পঞ্চনদে তার শাখা- সে তো নহে ক্ষীণ
সে তো নহে ধর্মে বর্ণে অবরুদ্ধ।
পঞ্চনদবাসী
কিবা হিন্দু কি মুসলিম্ শিখ আর যত শ্বেতত্রাসী
লালকেল্লা অধিবাসী– পাইল তোমার বক্ষে স্থান,
কে বলে বাঙালি তুমি? তব রক্তপাতে অভিযান
দেশের বিশ্বের অনন্ত মঙ্গল লাগি। হে অভয়,
জয় তব জয়।
প্রদোষের অন্ধকারে
নির্জীব নিদ্রায় ছিনু রুদ্ধ; নৈরাশ্যের কারাগারে
অবিশ্বাসে নিমজ্জিত। হেনকালে শুনি বজ্রশঙ্খ
হে পার্থসারথি লক্ষ। লৌহের কীলক পেতে অঙ্ক,
বক্ষ, ভাল, কী আদরে নিলে বরি মৃত্যু তুচ্ছ করি।
জীর্ণ এ জীবন মম পুণ্য হল বারে বারে স্মরি।
ক্ষান্ত রণ?
নহে নহে। শিবের তার অন্তহীন অনুক্ষণ,
কখনও বাহিরে কভু অন্তর্মুখী। এবে শান্ত শিব
লহ সংহরিয়া নিগূঢ় ধ্যানেতে, জ্বালো অস্তদীপ
জ্যোতির্ময়, গহন সাধন মাঝে হও নিমজ্জিত
যে-শক্তি সঞ্চয় হল চক্রাকারে করুক প্লাবিত
বৃদ্ধি পেয়ে, গতিবেগে, পর্বত করে নদী যথা
অবরুদ্ধ, কিন্তু বহির্মুখী।