আমি বললুম, না।
গাঁধীজি তাদের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাণ্ডেনের মুখেও হাসি নেই। আমাদের কাঞ্জেটির বড় নরম হৃদয়; বুঝতে পারলেন গাঁধীজির কোথায় বেজেছে।
খানিকক্ষণ পরে গাঁধীজি নিজেই বললেন, চলুন কাপ্তেন। তখন তিনি তাকে বাকি সব দেখালেন। সব শেষে নিয়ে গেলেন খোলা ডেকের উপর। সেখানে কাঠফাটা রোদ্দুর! কাপ্তেন বললেন, ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াবেন না, স্যার। সর্দিামি হতে পারে।
গাঁধীজি বললেন, কাপ্তেন সায়েব, এ জায়গাটি আমার বড় পছন্দ হয়েছে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে এখানে একটা তাবু খাঁটিয়ে দিন, আমি তাতেই থাকব। কাপ্তেনের চক্ষু স্থির! অনেক বোঝালেন, পড়ালেন। গাঁধীজি শুধু বলেন, অবিশ্যি আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে। কাপ্তেন কী করেন। তবু এল, খাটানো হল। গাঁধী সেই খোলা ছাদের তাবুতে ঝাড়া বারোটা দিন কাটালেন।
কাপ্তেন শয্যাগ্রহণ করলেন। জাহাজের ডাক্তারকে ডেকে বললেন, তোমার হাতে আমার প্রাণ। গাঁধীজিকে কোনওরকম জ্যান্ত অবস্থায় বোম্বাই পৌঁছিয়ে দাও। তোমাকে তিন ডবল প্রমোশন দেব।
আমি অবাক হয়ে শুধালম,-সব বন্দোবস্ত?
স্টুয়ার্ড হাতের তেলো উঁচিয়ে বলল, পড়ে রইল। গাঁধীজি খেলেন তো বরির দুধ আর পেঁয়াজের শুরুয়া। কোথায় বড় বাবুর্চি, আর কোথায় গান-বাজনা। সব ভণ্ডুল। শুধু রোজ সকালবেলা একবার নেবে আসতেন আর জাহাজের সবচেয়ে বড় ঘরে উপাসনা করতেন। তখন সেখানে সকলের অবাধ গতি–কেবিন-বয় পর্যন্ত।
কাপ্তেনের সব দুঃখ জল হয়ে গেল বোম্বাই পৌঁছে। গাঁধীজি তাকে সই করা একখানা ফোটো দিলেন। তখন আর কাপ্তেনকে পায় কে? আপনার সঙ্গে তার বুঝি আলাপ হয়নি? পরিচয় হওয়ার আড়াই সেকেন্ডের ভিতর আপনাকে যদি সেই ছবি উনি না দেখান তবে আমি এখান থেকে ইতালি অবধি নাকে খং দিতে রাজি আছি। হিসাব করে দেখা গেছে ইতালির শতকরা ৮৪.২৭১৯ জন লোক সে ছবি দেখেছে।
স্টুয়ার্ড কতটা লবণ-লঙ্কা গল্পে লাগিয়েছিল জানিনে; তবে সেই কথাগুলো ঠিক যে গান্ধীজি ওই জাহাজেই দেশে ফিরেছিলেন– পালাসো ভেনেসিয়া থেকে আসবাব এসেছিল, গান্ধীজি এঞ্জিনরুমে গিয়েছিলেন, জাহাজের দিনগুলো কাটিয়েছিলেন তাঁবুতে, আর নিচে নাবতেন উপাসনার সময়ে। অন্য লোকের মুখেও শুনেছি।
চরিত্র-বিচার
অঙ্কশাস্ত্রে প্রশ্ন ওঠে না, এ বাবদে আপনার কিংবা আমার অভিজ্ঞতা কী? রসনির্মাণে ঠিক তার উল্টো। সেখানে লেখক আপন অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্র নির্মাণ করেন, আর পাঠক আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটাকে অল্পবিস্তর যাচাই করে নেয়। কিন্তু যখন কোনও জাতির চরিত্র নিয়ে আলোচনা হয় তখন সেটাকে একদিক দিয়ে যেমন অঙ্কশাস্ত্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক করা যায় না, ঠিক তেমনি সেটাকে সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতার ওপরও ছেড়ে দেওয়া যায় না এবং তখন আবার এ প্রশ্ন ওঠে, যেসব লোক আলোচনায় যোগ দিলেন তাদের অভিজ্ঞতা এ বাবদে কতখানি।
আমার অতি সামান্য আছে। তাই এই ভূমিকা দিয়ে আরম্ভ করতে হল। এবং অনুরোধ, নিজের অভিজ্ঞতার দোহাই যদি মাত্রা পেরিয়ে যায় তবে যেন পাঠক অপরাধ না নেন। সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছায়। বাঙালিচরিত্র সম্বন্ধে যদি প্রামাণিক পুঁথি-প্রবন্ধ থাকত, তবে তারই ওপর নির্ভর করে আলোচনা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারত। তা নেই। বস্তুত আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় অন্য প্রদেশের লোক দ্বারা বাঙালি সম্বন্ধে অকৃপণ, অকরুণ নিন্দাবাদ থেকে। যথা বাঙালি বড় দী, বাঙালি অন্য প্রদেশের সঙ্গে মিশতে চায় না, সহৃদয় মন্তব্য যে একেবারেই শুনতে পাওয়া যায় না, তা নয়– যেমন শুনবেন, বাঙালি মেয়ে ভালো চুল বাঁধতে জানে, কিংবা ব্যবসাতে বাঙালিকে ঘায়েল করা (অর্থাৎ ঠকানো) অতি সরল।
আমি ভারতবর্ষের সব প্রদেশেই বাস করেছি। দিল্লিতেই প্রায় চার বৎসর ছিলুম। চোখ-কান খোলা-খাড়া না রাখলেও সেখানে আপনাকে অনেক খবর অনেক গুজব শুনতে হয়।
বাঙালির প্রতি আপনার যদি কোনও দরদ থাকে তবে কিছুদিনের মধ্যেই আপনি কতকগুলি জিনিস স্পষ্ট বুঝে যাবেন।
(১) সিন্ধি-পাঞ্জাবি দেশহারা হয়ে দিশেহারা হয়নি। সিন্ধিরা বোম্বাই অঞ্চলে, পাঞ্জাবিরা দিল্লি অঞ্চলে আপন ব্যবসা-বাণিজ্যে দিব্য গোছগাছ ছিমছাম করে নিয়েছে। বরঞ্চ অনেক স্থলে এদের সুবিধেই হয়েছে বেশি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। দিল্লির কনট সার্কাস থেকে মুসলমান হোটেলওয়ালারা চলে যাওয়াতে সেখানে পাঞ্জাবি গাদা গাদা রেস্তোরাঁ খুলেছে। (ফলে খাস দিল্লির মোগলাই রান্না, সেখান থেকে লোপ পেয়েছে এখন যা পাবেন সে বস্তু পাঞ্জাবি রান্না, লাহোর অঞ্চলের। দিল্লির রান্নার কাছে সে রান্না আজ পাড়াগেঁয়ে)। এই পাঞ্জাবিদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই। এদের কেউ কেউ পারমিট-গিরমিট ব্যাপারে আমার কাছে দৈবেসৈবে সাহায্য নিতে এসেছে–কিন্তু কখনও হাত পাতেনি। এরা যা খাটছে এবং খেটেছে তা দেখে আমি সর্বান্তঃকরণে এদের কল্যাণ এবং শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেছি।
তাই অতিশয় সভয়ে শুধুই, পুব-বাংলার লোক পশ্চিম-বাংলায় এসে অনেক করেছে, কিন্তু পাঞ্জাবি-সিন্ধিরা যতখানি পেরেছে ততখানি কি তাদের দ্বারা হয়েছে? এ বড় বে-দরদ এবং বেয়াদব প্রশ্ন। পূর্ববঙ্গবাসীরা এ প্রশ্নে আমার ওপর চটে গিয়ে অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবেন। আমি নতশিরে সব উত্তর মেনে নিচ্ছি এবং এ স্থলে আগেভাগেই বলে রাখছি, আমি তাদের উকিল হয়েই এ আলোচনা আরম্ভ করেছি, তাদেরই সাফাই গাইবার জন্য। একটু ধৈর্য ধরুন।