ব্যাটারা আমাদের জগন্নাথকে পর্যন্ত সমুদ্রযাত্ৰা করিয়ে দেশে নিয়ে ছেড়েছে। পারলে তাজমহল আর হিমালয়ও আগেভাগেই নিয়ে বসে থাকত-কেন পারে নি। তার কারণ বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
ফরাসি জাতটা ঠিক তার উল্টো। শব্দ গ্রহণ বাবদ সে যে কত মারাত্মক ছুঁৎবাইগ্ৰস্ত তা বোঝা যায় তার অভিধান থেকে। পাতার পর পাতা পড়ে যান, বিদেশী শব্দের সন্ধান পাবেন না। মনে পড়ছে, আমার তরুণ বয়সে শান্তিনিকেতনের ফরাসি অধ্যাপক বেনওয়া সায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। রোমা রলাঁর পঞ্চাশ না ষাট বছর পূর্ণ হওয়াতে পৃথিবীর বড় বড় রল-ভক্তেরা তখন তাকে একখানা রিল-প্রশস্তি উপহার দেন। এ-দেশ থেকে গাঁধী, জগদীশ বসু ওঁরা সব লিখেছিলেন-রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কি না ঠিক মনে পড়ছে না। বেনওয়া সায়েবও সে-কেতবে একখানা প্ৰবন্ধ লিখেছিলেন–বিষয়বস্তু শান্তিনিকেতনের আশ্রম’। ‘আশ্রম’ শব্দে এসে বেনওয়া সায়েবের ফরাসি নৌকা বানচাল হয়ে গেল। ‘আশ্রম’ শব্দটা ফরাসিতে লিখবেন কি প্রকারে, অথচ ফরাসি ভাষায় আশ্রম’ জাতীয় কোনো শব্দ নেই। আমি বললুম, ‘প্যারিস শহর আর ব্ৰহ্মচর্যাশ্রম যে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের দুই প্রান্তে অবস্থিতঅন্তত ভাবলোকে-সে কথা সবাই জানে, তবু-ইত্যাদি।’ বেনওয়া সায়েব ফরাসি কায়দায় শোলডার শ্রাগ করে বললেন, ‘উঁহু, বদহজম হবে।’ সায়েব শেষটায় কি করে জাতিরক্ষণ আর পেট ভরানোর দ্বন্দ্ৰ সমাধান করেছিলেন সে কথাটা এতদিন বাদে আজ আমার আর মনে নেই।
অর্থাভাববশত একদা আমাকে কিছুদিনের জন্য এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর ফ্রান্সাগত ফরাসি চিঠি-পত্রের অনুবাদ করে দিতে হয়েছিল। মনে পড়ছে, কারবারে ফরাসি পক্ষ হামেশাই ইংরেজ পক্ষকে দোষারোপ করতো যে ইংরেজ অনেক সময় আপন অভিসন্ধি সাফ সাফ বলে না। ইংরেজি ভাষায় শব্দসম্পদ প্রচুর বলে ইচ্ছে করলেই আপনি বক্তব্য ঘোলাটে, আবছা আবছা করে লেখা যায়। ফরাসিতে সেটি হবার জো নেই। যা বলার সেটা পরিষ্কার হয়ে বেরবেই বেরবে। (লক্ষ্য করে থাকবেন কাচাবাচ্চার শব্দ-সম্পদ সীমাবদ্ধ বলে তাদের কথায় সব জিনিসই হয় কালো নয়। ধলা, সব কিছুই পরিষ্কার, কোনো প্রকারের হাফটোন নেই)। তাই ফরাসি এই চিঠিপত্র লেনদেনের ব্যাপারে পড়লো বিপদে।
কিন্তু ফরাসিরাও গম যব দিয়ে দিয়ে লেখাপড়া শেখে না। তাই শেষটায় ফরাসি কারবারি হুমকি দিল, সে ইংরেজ রেখে চিঠি-পত্ৰ ইংরিজিতে লেখাবে। ইংরেজ হস্তদন্ত হয়ে চিঠি লিখল, ‘সে কি কথা, আপনাদের বহুৎ তকলিফ হবে, বড় বেশি বাজে খৰ্চা হবে, এমন কৰ্ম্ম করতে নেই।’
তখন একটা সমঝাওতা হল।
***
Gepaeckaufbewahrungstelle!
শব্দটা শুনে মূৰ্ছা যাই আর কি! প্রথমবার বার্লিন যাচ্ছি, জর্মন ভাষার জানি শুধু ব্যাকরণ, আর কণ্ঠস্থ আছে হাইনরিশ হাইনের গুটিকয়েক মোলায়েম প্রেমের কবিতা। সে-রেস্ত দিয়ে তো বার্লিন শহরে বেসাতি করা যায় না। তাই একজন ফরাসি সহযাত্রীকে ট্রেনে বার্লিন পৌঁছবার কিছু আগে জিজ্ঞেস করলুম, ‘ক্লোক-রুম’’ বা ‘লেফট-লগেজ-অফিসের’ জর্মন প্রতিশব্দ কি? বললেন–
Gepaeckaufbewahrungstelle!
প্রথম ধাক্কায়ই এ-রকম আড়াইগজী শব্দ মুখস্থ করতে পারবো, সে দুরাশা আমি করি নি। মসিয়োও আঁচতে পারলেন বেদনোটা—একখানা কাগজে টুকে দিলেন শব্দটা। তাই দেখলুম। বার্লিন স্টেশনের এক পোর্টারকে। মাল সেখানে রেখে একদা হোটেল খুঁজে নিলুম। ভাগ্যিস ‘’হোটেল’ কথাটা আন্তর্জাতিক-না হলে ক্লোক-রুমের তুলনায় হোটেলের সাইজ যখন পঞ্চাশগুণ বড় তখন শব্দটা পঞ্চাশগুণ লম্বা হত বই কি।
জর্মন ভাষার এই হল বৈশিষ্ট্য। জর্মন ইংরিজির মত দিল-দরিয়া হয়ে যত্রতত্র শব্দ কুড়োতে পারে না, আবার ফরাসির মত শব্দতাত্ত্বিক বাত-ব্যামোও তার এমন ভয়ঙ্কর মারাত্মক নয় যে উবু হয়ে দু’একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ কুড়োতে না পারে। শব্দ সঞ্চয় বাবদে জর্মন ইংরেজি ও ফরাসির মাঝখানে। তার সম্প্রসারণক্ষমতা বেশ খানিকটা আছে; কিন্তু ইংরিজি রবারের মত তাকে যত খুশি টেনে লম্বা করা যায় না।
জর্মন ভাষার আসল জোর তার সমাস বানাবার কৌশলে আর সেখানে জর্মনের মত উদার ভাষা উপস্থিত পৃথিবীতে কমই আছে।
এই যে উপরের শব্দটা শুনে বিদগ্ধ পাঠক পর্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন সেইটেই নিন! Gepaeck অর্থ যা প্যাক করা যায়, অর্থাৎ লাগেজ, aufibewahrung অর্থ তদারকি করা (ইংরিজি beware কথা থেকে bewahrung); আর stelle কথার অর্থ জায়গা। একুনে হল লাগেজ তদারকির জায়গা’। জর্মন সবকটা শব্দকে আলাদা আলাদা রূপে বিলক্ষ চেনে বলেই সমাসটার দৈর্ঘ্য তাকে কিঞ্চিৎমাত্র বিচলিত করে না।
তুলনা দিয়ে বক্তব্যটা খোলসা করি।
‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ কথাটার সামনে আমরা মোটেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই নে। তার কারণ, কর্তব্য আর বিমূঢ় আমরাই হামেশাই ব্যবহার করি আর কিং কথাটার সঙ্গেও আমাদের ঈষৎ মুখ চেনাচেনি আছে। কাজেই সমাসটা ব্যবহার করার জন্য আমাদের বড্ড বেশি ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রয়োজন হয় না। যারা সামান্যতম বাঙলা জানে না তাদের কথা হচ্ছে না, তারা নিত্যসা ফতেনা দিয়ামা’ করে এবং ঘৃত-তৈল-লবণ-তণ্ডুল-বস্ত্ৰ ইন্ধনের সামনে ঘরপোড়া গোরুর মত সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়।
বড্ড বেশি লম্বা সমাস অবিশ্যি কাজের সুবিধে করে দেয় না। তাই যারা সমাস বানাবার জন্যই সমাস বানায় তাদের কচকচানি নিয়ে আমরা ঠাট্টা-মস্করা করি। জর্মনরাও করে। রাজনৈতিক বিসমার্ক পর্যন্ত সমাস বানাবার বাই নিয়ে ঠাট্টা করতে কসুর করেন নি। ‘ড্রগিস্ট’ শব্দটা জর্মনে চলে, কিন্তু তার একটা উৎকট জর্মন সমাস স্বয়ং বিসমার্ক বানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।