রসবোধ ছাড়া অন্য একটি গুণ ছিল আনিকির। হাজির-জবাব। কিছু বললে চট করে তার জুৎসই জবাব তার জিভে হামোহাল হাজির থাকত।
একদিন বেড়াতে বেরিয়েছি তার সঙ্গে। এক ডেপো ছোকরা আনিকির দৈর্ঘ্য দেখে তাকে চেচিয়ে শুধালে, ‘মাদমোয়াজেল, উপরের হাওয়াটা কি ঠাণ্ডা?’
আনিকি বললেন, ‘পরিষ্কার তো বটেই। তোমার বোিটকা প্রশ্বাস সেখানে নেই বলে।’
আনিকির সঙ্গে আমাদের এতখানি হৃদ্যতা হয়েছিল যে তিনি আমাদের সঙ্গে লজান, মন্ত্রো, লুৎর্সেন, ইন্টেরল্যাকেন, ৎসুরিশ সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন।
বিদায়ের দিন শ্ৰীমতী বসু তো কেঁদেই ফেললেন।
***
দু’এক বৎসর আমাদের সঙ্গে পত্র ব্যবহার ছিল। তার পর যা হয়-আস্তে আস্তে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। r
তারপর বহু বৎসর কেটে গিয়েছে, এখানে এক ফিন মহিলার সঙ্গে আলাপ। শুধালুম, ‘প্রেসিডেন্ট পাসিকিভির মেয়েকে চেনেন?’
গুম হয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ। তারপর শুধালেন, ‘আপনার সঙ্গে এখন কি তার যোগাযোগ নেই?’
আমি বললুম, ‘বহু বৎসর ধরে নেই।’
বললেন, ‘তিনি চার মাস ধরে হাসপাতালে। পেটের ক্যানসার। বাঁচবেন না। আপনি একটা চিঠি লিখুন না। অবশ্য অসুখের কথা উল্লেখ না করে। জাসটি, এমনি হঠাৎ যেন মনে পড়ছে।’
সে রাত্রেই লিখলুম।
দিন চারেক পরে আরেক পার্টিতে সেই ফিন মহিলার সঙ্গে দেখা। সুধালেন, ‘চিঠি লিখেছেন?’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ’।
বললেন, ‘দরকার ছিল না। কাল দেশের কাগজে পড়লুম, মারা গেছেন।’
আমার ভাণ্ডার আছে ভরে
শব্দপ্রাচুর্যের উপর ভাষার শক্তি নির্ভর করে। ইংরেজি এবং বাংলা এই উভয় ভাষা নিয়ে যাদের একটুখানি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়, তারাই জানেন বাঙলার শব্দ-সম্পদ কত সীমাবদ্ধ। ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনীয়ারিং টেকনিকেল শব্দের কথা তুলছি নে—সে সব শব্দ তৈরি হতে দেরি—উপস্থিত সে শব্দের কথাই তুলছি যেগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রেই সর্বদা দরকার হয়।
ইংরেজির উদাহরণই নিন। ইংরেজি যে নানা দিক দিয়ে ইয়োরোপীয় সর্বভাষার অগ্রগণ্য তার অন্যতম প্রধান কারণ ইংরেজির শব্দ-সম্পদ। এবং ইংরেজি সে সম্পদ আহরণ করেছে অত্যন্ত নির্লজের’র মত পূর্ব-পশ্চিম সর্ব দেশ মহাদেশ থেকে। গ্ৰীক, লাতিনের মত দুটো জোরালো ভাষা থেকে তার শব্দ নেবার হক তো সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েইছে, তার উপর ফরাসির উপরও ওয়ারিশন বলে তার ষোল আনা অধিকার। তৎসত্ত্বেও-সুকুমার রায়ের ভাষায় বলি—
এতো খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা
খাও তবে কচু-পোড়া খাও তবে ঘণ্টা!
ইংরেজ উত্তরে বেশিরমের মত বলে, ‘ঠিক বলেছে, আমার মনে ওঠে নি, আমি কচুপোড়া এবং ঘণ্টা খেতেও রাজী!’
তাই দেখুন ইংরেজ, আরবী, ফার্সী, তামিল, হিন্দি, মালয়—কত বলবো?-দুনিয়ায় তাবৎ ভাষা থেকে কচু-পোড়া ঘণ্টা সব কিছু নিয়েছে, এবং হজমও করে ফেলেছে। ‘এডমিরাল নিয়েছে আরবী, ‘আমীর-উল-বহর’ থেকে, ‘চেক’ (কিস্তিমতের) নিয়েছে পাসী। ‘শাহ’ থেকে, ‘চুরুট’ নিয়েছে তামিল ‘শুরুট্টু’ থেকে, ‘চৌকি’ নিয়েছে হিন্দি থেকে, ‘এমাক’ নিয়েছে মালয় থেকে।
(কিন্তু আশ্চর্য, ইংরেজের এই বিদঘুটে গরুড়ের ক্ষুধা শব্দ বাবদেই; আহারাদির ব্যাপারে ইংরেজ নকিষ্যি কুলীনের মত উন্নাসিক, কট্টর স্বপাকে খায়, এদেশে এত কাল কাটানোর পরও ইংরেজ মাস্টার্ড (অর্থাৎ সর্ষেবাটা বা কাসুন্দি) এবং মাছে মিলিয়ে খেতে শেখে নি, অথচ কে না জানে সর্ষেবাটায় ইলিশ মাছ খাদ্য-জগতে অন্যতম কুতুব-মিনার? ইংরেজ এখনো বিস্বাদ ফ্রাইড ফিশ খায়, মাছ বাছতে শিখলো না; আমরা তাকে খুশি করার জন্য পাস্তুয়ার নাম দিলুম লেডিকিনি (লেডি ক্যানিং) তবু সে তাকে জাতে তুললো না, ছানার কদর বুঝলো না। তাই ইংরেজের রান্না এতই রসকষ-বর্জিত, বিস্বাদ এবং একঘেয়ে যে তারই ভয়ে কন্টিনেন্টাল মাত্ৰই বিলেত যাবার নামে আঁৎকে ওঠে-যদি নিতান্তই লন্ডন যায়। তবে খুঁজে খুঁজে সোহো মহল্লায় গিয়ে ফরাসি রেস্তোরায় ঢুকে আপন প্রাণ বাঁচায়। আমার কথা বাদ দিন, আমার পেটে এটম বোম মারলেও আমি ইংরিজি খানা দিয়ে আমার পেট ভরাতে রাজী হবে না।)
শব্দের জন্য ইংরেজ দুনিয়ার সর্বত্র ছোঁক ছোক করে বেড়ায় সে না হয়ে বুঝলুম; কিন্তু ইংরেজের মত দন্তী জাত যে দুশমনের কাছ থেকেও শব্দ ধার নেয়। সেইটেই বড় তাজবীকী বাৎ{ এই লড়াইয়ের ডামাডোলে সবাই যখন আপনি আপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তখনো ইংরেজ গোটা কয়েক শব্দ দুশমনের কাছ থেকে ধার নিয়ে দাঁত দেখিয়ে হোসেছে। লুফট-ভাফফের মার খেয়ে খেয়ে ইংরেজ যখন মর-মর তখনো সে মনে মনে জপছে, লুফট-ভাফফে, লুফট-ভাফফে, শব্দটা ভুললে চলবে না’, ক্লিৎসক্রীগের ঠেলায় ইংরেজ যখন ডানকার্কে ডুবু ডুবু তখনো ইষ্টনাম না জপে সে জপেছে, ‘ব্লিৎস-ক্রীগ, ক্লিৎস-ক্রীগ।’
আর বেতামিজীটা দেখুন। গালাগাল দেবার বেলা যখন আপন শব্দে কুলোয় না— মা লক্ষ্মী জানেন সে ভাণ্ডারেও ইংরেজের ছয়লাব-তখনো সে চক্ষুলজার ধার ধারে না। এই তো সেদিন শুনলুম কাকে যেন স্বাধিকার প্রমত্ত’ বলতে গিয়ে কোনো এক ইংরেজ বড় কর্তা শত্রুপক্ষকে শাসিয়েছেন, ‘আমাদের উপর ফ্যুরার-গিরার ফাপরদালালি করো না।’
পাছে এত সব শব্দের গন্ধমাদন ইংরেজকে জগন্নাথের জগদ্দল পাথরে চেপে মারে তাই তার ব্যবস্থাও সে করে রেখেছে। ‘জগন্নাথ’ কথাটা ব্যবহার করেই সে বলেছে, ‘ভেবে চিন্তে শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করবে-পাগলের মত ডোন্ট থ্রো ইয়োরসেলভস আন্ডার দি হুইল অব Juggernaut (জগন্নাথ) ‘