আপনি এদের চেয়ে বছর দশেক বড়, তাই এরা আপনাকে একটুখানি সমীহ করে, যদিও আড় না হয়েই বিড়ি টানে। কারণ এদেশে সে রেওয়াজটা তেমন নেই। আপনি নিতান্ত বিদেশী বলেই এ আড্ডায় ছিটকে এসে পড়েছেন। এদের কাউকে পয়লা আড্ডায় নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি নিয়ে গিয়েছিলুম; বেচারী সেখানে রাটি কাড়ে নি যদ্যপি দুসর আড্ডাতে সে-ই তড়পাতো সব চেয়ে বেশি।
তা ছাড়া আপনি মাসে এক দিন কিংবা দুদিন শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা কাফেতে যান। আপনার এক বন্ধু সে কাফেটারই উপরতলায় থাকেন। খাসা জায়গায়সামনেই নীল নদ বয়ে যাচ্ছে। আপনারই বন্ধু এখানকার এ-আড্ডার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। র্ত্যকে প্রথম খুঁজবেন কাফেতে-সেখানে না পেলে অবশ্য তাঁর ফ্ল্যাটে যেতে পারেন, তাতে কিন্তু কোনো লাভ নেই।
এ কাফে আপনাকে উদ্বাহু হয়ে অভ্যর্থনা করবে যেন আপনি অনেক দিনের হারিয়েযাওয়া ফিরে-পাওয়া ভাই। কারণ আপনি এখানে আসেন কালেভদ্রে। আপনাকে পেয়ে এঁদের বিশেষ আনন্দ কারণ পক্ষাধিক কাল ধরে তাঁরা যে সব বিষয়ে কেটেকুট ঘষে পিষে চাটনি বানিয়ে ফেলেছিলেন সেগুলো তারা নূতন করে হাড়িকাটে ঢুকিয়ে রাম-দা ওঁচাবেন। আপনার রায় জানতে চাইবেন। যে রায়ই দিন না কেন আপনার উদ্ধার নেই। আপনি যদিও গাঁধীর দেশের লোক-আপনি অবশ্য একশ বার ওঁদের বলেছেন যে, গাঁধীর সঙ্গে আপনার কোনো প্রকারে সাক্ষাৎ যোগাযোগ নেই, কিন্তু তাতে করে কোনো ফায়দা ওৎরায় না।—যদিও আপনার জ্ঞানগম্যতে কারো কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আপনি গুহা। ষষ্ঠেন্দ্ৰিয় ধারণ করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু স্বীকার করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আপনি নিৰ্ঘাৎ শেষ বাস মিস করবেন। বন্ধুর ফ্ল্যাটে সোফার উপর চতুর্থ যাম যাপন করে। পরদিন সকাল বেলা বাড়ি ফিরবেন।
আনিকি পাসিকিভি
এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে জিনীভার এক বড় হোটেলে উঠেছি। প্রথম দিনই খানাঘরে লক্ষ্য করলুম, আমাদের টেবিলের দিকে মুখ করে বসেছেন এক দীর্ঘাঙ্গী যুবতী। দীর্ঘাঙ্গী বললে কম বলা হয়, কারণ আমার মনে হল এর দৈর্ঘ্য অন্ততপক্ষে পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি হবে-আর আমরা তিনজন বাঙালি গড়পড়তায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি হই কি না-হই।
দৈর্ঘ্যের সঙ্গে মিলিয়ে সুগঠিত দেহ–সেইটেই ছিল তাঁর সৌন্দর্য, কারণ মুখের গঠন, চুলের রঙ এবং আর পাঁচটা বিষয়ে তিনি সাধারণ ইয়োরোপীয় রমণীদেরই মত।
ভদ্রতা বজায় রেখে আমরা তিনজনই যুবতীটিকে অনেকবার দেখে নিলুম। ফিস ফিস করে তার সম্বন্ধে আমাদের ভিতরে আলোচনাও হল। তখন লক্ষ্য করলুম, আমাদের দিকে তিনিও দু’চারবার তাকিয়ে নিয়েছেন।
সেই সন্ধ্যায় বাঙালি ভদ্রমহিলাটি হোটেলের ড্রয়িংরুমে বারোয়ারি রেডিয়োটা নিয়ে স্টেশন খোঁজাখুঁজি করছিলেন; আমি একপাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলুম। হঠাৎ সেই যুবতী ঘরে ঢুকে সোজা মহিলাটির কাছে গিয়ে পরিষ্কার ইংরিজিতে বললেন, ‘আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি? আপনি কি কোনো বিশেষ স্টেশন খুঁজছেন? আমার বেতারবাই আছে।’
পরিচয় হয়ে গেল। রোজ খাবার সময় আমাদের টেবিলেই বসতে আরম্ভ করলেন। নাম আনিকি পাসিকিভি-দেশ ফিনল্যান্ডে।
ফিনল্যান্ডের আর কাকে চিনব? ছেলেবেলায় ফিন লেখক জিলিয়াকুসের ‘রুশ বিদ্রোহের ইতিহাস’ পড়েছিলুম আর তাঁর ছেলে জিলিয়াকুসও বিখ্যাত লেখক—প্রায়ই ‘নিউ স্টেটসম্যানে’ উচ্চাঙ্গের প্রবন্ধাদি লিখে থাকেন। ব্যস।
কিন্তু তবু যেন পাসিকিভি নামটা চেনা-চেনা বলে মনে হয়। সে কথাটা বলতে আনিকি একটুখানি লজ্জার সঙ্গে বললেন, ‘আমার বাবা ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট।’
আমরা তিনজনেই একসঙ্গে বললুম, ‘অ।’
আনিকির সঙ্গে আলাপ হওয়াতে আমাদের ভারি সুবিধে হল। বাঙালি দম্পতি ইংরিজি আর বাঙলা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা জানতেন না, কাজেই আমাকে সব সময়ই ওঁদের সঙ্গে বেরতে হত। আনিকি অনেকগুলো ভাষা জানতেন; তিনি তাদের নিয়ে বেরতেন। আর আমি য়ুনিভার্সিটি, লাইব্রেরি, মিটিং-মাটিং করে বেড়াতুম।
সুইস খানা যদিও বেজায় পুষ্টিকর। তবু একটুখানি ভেঁাতা—আনিকি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা কয়ে তার পরিপটি ব্যবস্থা করে দিলেন। শামুনিকস দেখতে যাবার জন্য মোটর ভাড়া করতে যাচ্ছি-আনিকি এক দোস্তের গাড়ি ফিরিগ্র্যাটিস-অ্যান্ড-ফারনাথিং যোগাড় করে দিলেন। তা ছাড়া জিনীভা, লজান, মন্ত্রো, ভিলনভূ (রমা রলাঁ সেখানে থাকতেন) সম্বন্ধে দিনের পর দিন নানাপ্রকারের খবর দিয়ে আমাদের ওয়াকিবহাল করে তুললেন।
সূক্ষ্ম রসবোধও আনিকির ছিল। আমি একদিন শুধালুম, ‘আপনি অতগুলো ভাষা শিখলেন কি করে?’
বললেন, ‘বাধ্য হয়ে। ইয়োরোপের খানদানী ঘরের মেয়েদের মেলা ভাষা শিখতে হয় বরের বাজার কর্নার করার জন্য। ইংরেজ ব্যারণ, ফরাসী কাউন্ট, ইটালিয়ান ডিউক সক্কলের সঙ্গে রসালাপ না করতে পারলে বর জুটবে কি করে?’
তারপর হেসে বললেন, ‘কিন্তু সব শ্যাম্পেন টক্! এই পাঁচ ফুট এগারোকে বিয়ে করতে যাবে কোন ইংরেজ, কোন ফরাসি? তাকে যে আমার কোমরে হাত রেখে নাচতে হবে বিয়ের রাতের বল ডানসে! যা দেখতে পাচ্ছি, শেষটায় জাতভাই কোনো ফিনকেই পাকড়াও করতে হবে!’
আমি শুধালুম, ‘ফিনরা কি বেজায় ঢাঙা হয়?’
বললেন, ‘ছয়, ছয় তিন, ছয় ছয় হামেশাই। তাই তো তারা আর পাঁচটা জাতিকে আকসার হাইজাম্পে হারায়।’