লেজাঁয় যক্ষ্মরোগের জন্য কি চিকিৎসা করা হয়, সে সম্বন্ধে সালঙ্কার বিবৃতি দেবার প্রয়োজন নেই। দক্ষিণ ভারতের মদনপল্লীর আরোগ্য-বরমে’ যে-সব ব্যবস্থা আছে, সেগুলো তো আছেই তার উপর লেজ এবং ডাভোসের অন্যান্য মামুলী সানাটরিয়াতে যক্ষ্মরোগ বাবদে যে-সব গবেষণা অষ্টপ্রহর করা হচ্ছে, তার ফলও মসিয়ো ভোতিয়ে অহরহ পাচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদান। এবং তার এক প্রধান অঙ্গ নানা দেশের নানা গুণীকে লেজাঁতে নিমন্ত্রণ করে তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করা। তার জন্য ভোতিয়ের প্রতিষ্ঠানে একটি চমৎকার লেকচার থিয়েটার আছে। অন্যান্য সানাটরিয়াতে এরকম হলের প্রয়োজন হয় না।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি লেজাঁ পৌঁছবার ঠিক কয়েকদিন আগে দু-তিনজন বড় বড় ‘পণ্ডিতের গুরু গুরু ভাষণের গুরুভোজনের ফলে ছেলেমেয়েরা ঈষৎ কাতর হয়ে পড়েছিল। তাই বোধ করি, মসিয়ো ভোতিয়ে একটা জব্বর রকমের জোলাপের ব্যবস্থা করেছিলেন। মসিয়ো ভোতিয়ে আমাকে সোজাসুজি বললেন, ‘আপনি একটা লেকচার দিন। জর্মন কিংবা ফ্রেঞ্চ, যে-কোনো ভাষায়!
আমি বললুম, ‘আপনি যদিও জাতে সুইস, আপনার মাতৃভাষা ফরাসি এবং আপনি ফরাসি ঐতিহ্যে গড়ে-ওঠা বিদগ্ধজন। কাজেই আপনিও নেপোলিয়নের মত ‘অসম্ভব’ কথাটায় বিশ্বাস করেন না এবং তাই আপনার পক্ষে এ অনুরোধ করাটা অসম্ভব নয়; আমি কিন্তু ফরাসি নয়, আমি অসম্ভব’ কথাটা জানি এবং মানি। আমার পক্ষে বক্তৃতা দেওয়া অসম্ভব।
এগারো বৎসর হয়ে গিয়েছে, সম্পূর্ণ কথোপকথনটা আমার আজ আর মনে নেই। তবে চোখ বন্ধ করলে যে ছবিটি এখনো মনের ভিতর দেখতে পাই, তাতে আছে-এক বিরাট ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন যেন আমার দিকে দু’বাহু বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে আর আমি ক্রমেই পিছু হটে হটে শেষটায় দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আর পিছু হটবার জায়গা নেই। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দুহাত আমার গলা টিপে ধরেছে। হাত দুখানি বলছে, ‘এতগুলো রোগীকে আপনি নিরাশ করবেন?’
আমি অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিলুম,
‘পড়েছি যবনের হাতে
খানা খেতে হবে সাথে।’
***
ঝটপট ইশতিহার বেরিয়ে গেল ‘ভারতীয় অমুক কাল সন্ধ্যায় লেজাঁর ‘সানাতরিয়াঁ ইউনিভের্সিতের সুইসে’ একখানা ভাষণ দেবেন। বিষয়…। লেজাঁর তাবৎ সানোতরিয়ার অধিবাসিকৃন্দকে সাদর নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ ভোতিয়ে সাহেবের প্রতিষ্ঠানের পাঁচজন তো আসবেনই, অন্যান্য সানাতরিয়াঁর আরো বহু দুশমনকে ডাকা হয়েছে আমার মুখোশ খসাবার জন্য-কিন্তু ধর্ম সাক্ষী, আমি অনেক মুখোশ পরেছি বটে, পাণ্ডিত্যের মুখোশ কখনো পরি নি।
ভোতিয়ে বললেন, ‘চলুন, হলটার ব্যবস্থা কি রকম হল দেখবেন।’
লোকটা নিশ্চয়ই স্যাডিস্ট। এই যে সামনে পুজো আসছে, আমরা তো কখনো বলির মোষটাকে হাড়িকাঠ। দেখিয়ে চ্যাটাস চ্যাটাস করে ঠোঁট চাটিনে।
গিয়ে দেখি মধ্যিখানে বেশ খানিকটে জায়গা ফাঁকা রেখে চতুর্দিকে চেয়ার বেঞ্চি পাতা হয়েছে। তবে কি আমাকে ওখানে ফেলে জবাই করা হবে-আমার ছট্ফটানির জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা করা হয়েছে? কি হবে বৃথা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে? গর্দিশ, গর্দিশ, সবই কপালের গর্দিশ।
তোতিয়ে ব্যবস্থাটা দেখে চ্যাটাস চ্যাটাস করলেন, অদৃশ্য সাবানে হাত দুটো কচলালেন। বুঝলুম, আমার অনুমান ভুল নয়। জবাইটা জব্বর ধরনেরই হবে।
ফ্রম থর্ন টু থর্ন অর্থাৎ কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় ভোতিয়ে আমাকে সেই হলে নিয়ে ঢোকালেন।
দেখি ফাঁকা জায়গাটা ভরে গিয়েছে বিস্তর হুইল-চেয়ারে। যে-সব রোগীর পায়ের হাড়ে যক্ষ্মা অথবা যাদের নড়াচড়া করা বারণ, তাদের আনা হয়েছে হুইল-চেয়ারে করে। জন দুই শুয়ে আছে লম্বা লম্বা কৌচ সোফায়। পরে জানলুম, যারা নিতান্তই খাট ছাড়তে পারে না তাদের জন্য ঘরে ঘরে ইয়ার ফোনে’র ব্যবস্থা করা হয়েছে।
একজন দেখি হুইল-চেয়ারে বসে পাইপ টানছে। তখন আমার গর্দানে ঘি মালিস করা হচ্ছে—অর্থাৎ কে যেন যা-তা আবোল-তাবোল বকে আমার পরিচয় দিচ্ছে। ভোতিয়ে আমার পাশে বসে-পাছে আমি শেষমূহুর্তে পালাবার চেষ্টা করি। কানে কানে জিজ্ঞেস করলুম, ‘পাইপ সিগারেট খাওয়া যক্ষ্মরোগীদের বারণ নয়?’ ভোতিয়ে বললেন, ‘ভিতরে তামাক না থাকলে নিশ্চয়ই বারণ নয়।’ আমি বললুম, অর্থাৎ?’ অর্থাৎ বেচারীর যক্ষ্মা হওয়ার পূর্বে সে দিনরাত পাইপ টানত। অভ্যাসটা সম্পূর্ণ ছাড়তে পারে নি বলে এমন খালি-পাইপ কামড়ায়। ধুঁয়ো বেরুচ্ছে না বলে দাঁত কিড়ি মিড়ি খায়, আর হরেন্দরে প্রতি মাসে গোটা সাতেক ভাঙে। কিন্তু ছেলেটা পাইপ বাবদে জিউরি। ‘ব্রায়ার’ ছাড়া অন্য কোনো পাইপ চিবোতে রাজী হয় না।’
আপনি ভাবছেন, শ্রোতারা যক্ষ্মরোগী, তাই তাদের বিবৰ্ণ বিশীর্ণ মুখচোখ। আদপেই না। আপেলের মত লাল গাল প্রায় সব্বায়ের, চোখে মুখে উৎসাহ আর উত্তেজনা। যার দিকে তাকাই সেই যেন আমায় হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে নিচ্ছে, সবাই যেন বলছে, ‘কি ভয় তোমার? এত দূর দেশ থেকে এসেছে, যা-ই বলো না কেন আমরা কান পেতে শুনবো।’
তবু আমি মনে মনে গুরুদেবকে স্মরণ করলুম আমাকে ত্ৰাণ করার জন্য।
তারপর কি হল?
তারপর কি হল? ভয়ে আমার হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছে; আর আজ যদি আপনাদের কাছে স্বীকারও করি যে তারা বক্তৃতা-শেষে আমার দিকে পচা ডিম আর পচা টমাটো ছুড়েছিল, তাহলেও আপনাদের চারখানা হাত গজাবে না।