‘তাই তারা রোগের সঙ্গে লড়বার আর কোনো প্রয়োজন দেখতে পায় না, সব হিম্মত হারিয়ে ফেলে, এগিয়ে মৃত্যুর হাতে আপন জানটি ভেট দেয়।’
মসিয়ো ভোতিয়ে বললেন, যাবে থেকে আমি যক্ষ্মা রোগ নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছি তখন থেকেই আমি কাজে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে, অবসর সময়ে অহরহ ভেবেছি। এর কোনো প্ৰতিকার করা যায়। কিনা? শেষ পর্যন্ত আমি যে প্ৰতিকার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি তারই ভিতরে আজ আপনি আমি বসে কথা বলছি—তার নাম ‘সানাটরিয়া ইউনিভেসিতের’, অর্থাৎ ‘বিশ্ববিদ্যালয় আরোগ্যায়তন’।
‘এখানে শুদ্ধৃমাত্র কলেজের ছেলেমেয়েদের নেওয়া হয়। এবং জিনীভা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের বন্দোবস্ত, যেন আমাদের রোগীদের টার্ম হিসেবে নেওয়া হয় অর্থাৎ এরা জিনীভায় ক্লাস না করে ক্লাস করছে এই সানাটোরিয়ামে। এরা এখানেই পড়াশোনা করে, সুইটজারল্যান্ডের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকরা এখানে এসে মাঝে মাঝে লেকচার দিয়ে যান, তাছাড়া যক্ষ্মবৈরী বহু নিমন্ত্রিত রবাহুত গুণী এখানে এসে দু’দশ দিন থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় নানাপ্রকারে সাহায্য করে যান।
‘বুঝতেই পারছেন, ‘যে-সব বিষয় নিলে ভয়ঙ্কর বেশি খাটতে হয়, সেগুলোর ব্যবস্থা এখানে নেই। তাই নিয়ে ছেলেমেয়েরাও বেশি কান্নাকাটি করে না, তারা জানে, সে ধরনের পড়াশোনা করলে তাদের শরীর কখনো সারবে না। তারা খুশি কোনো কিছু একটা নিয়ে পাশ দিতে পারলেই; কাজেই বিজ্ঞানের ছেলে দর্শন নিতে আপত্তি করে না, ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছেলে ইতিহাস উৎসাহের সঙ্গেই পড়ে।
‘অবশ্য স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর পড়াশোনার মেকদার নির্ভর করে। আমাদের সব সময় কড়া নজর, কেউ যেন বড্ড বেশি না খাটে। কিছুদিন থাকার পর রোগীরাও তত্ত্বটা বুঝে ফেলে, আর নূতন রোগীদের ধমক দিয়ে ব্যাপারটা তাদের কাছে জলের মত তরল করে দেয়। আমাকে তো আজকাল এ-নিয়ে বিলকুল মাথা ঘামাতে হয় না। ওদের চিকিৎসার দিকে এখন আমি আরো বেশি সময় দিতে পারি।’
একটুখানি চোখ টিপে মুচকি হেসে বললেন, ‘পড়াশোনা বিশেষ হয় না, সে তো বুঝতেই পারছেন। তা নাই বা হল। ছেলেমেয়েরা সাহস তো পায় বেঁচে থাকবার, সেইটেই হল আসল কথা। জিনীভা বিশ্ববিদ্যালয়ও আমার কলটা বেশ বুঝতে পেরেছেন, আমিই তাদের খোলাখুলি বলে রেখেছি, এখানে মধ্যযামিনীর তৈল ক্ষয় নিষিদ্ধ, বেশি পড়াশোনা এখানে হতেই পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষেরা তো আর হৃদয়হীন পাষাণ নন; এখান থেকে যারা পরীক্ষা দেয়, তাদের প্রতি তারা সদয়, আর যারা সেরে উঠে বাকি টার্মগুলো জিনীভায় কাটায় তাদের প্রতিও মোলায়েম ব্যবহার করেন।’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কিন্তু টাকা পাই কোথায়? অঢেল টাকার দরকার। আমি পনেরো বছর ধরে তামাম ইয়োরোপ চষে বেড়াচ্ছি। টাকার জন্য। মুসসোলীনি, লয়েড জর্জ থেকে আরম্ভ করে যেখানে যে আমাকে সামান্যতম সাহায্য করতে পারে তারই দরজায় হ্যাট পেতে ভিক্ষা মেঙেছি।
‘এখন আমার ইচ্ছা এ-প্রতিষ্ঠানটিকে ইন্টারনেশনাল–সার্বজনীন সার্বভৌমিক করার। ভারতবর্ষ থেকে যদি রোগী ছাত্র আসে। তবে তার জন্য যেন এখানে আমি ব্যবস্থা করতে পারি, সেও যেন নিরাময় হয়, সঙ্গে সঙ্গে জিনীভা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি নিয়ে ফিরতে পারে। আপনাদের দেশে তো রাজা মহারাজদের অনেক টাকা-দানখয়রাতও তারা করেন। শুনেছি।’
আমি মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললুম, ‘এককালে রাজ-রাজড়ারা বিস্তর দান-ধ্যান করতেন এ-কথা সত্যি, আজকালও যে একেবারেই নেই সে-কথা আমি বলব না। আপনি যদি স্বয়ং ভারতবর্ষে আসেন তবে একটা চেষ্টা দিয়ে দেখতে পারি। আমার দ্বারা যোগসূত্র স্থাপনের যেটুকু সামান্য সাহায্য সম্ভবপর–
ডক্টর ভোতিয়ে আমার দু’খানা হাত চেপে ধরে নীরবে আমার চোখের দিকে সকৃতজ্ঞ নয়নে তাকিয়ে রইলেন।
আমি দেশে ফিরে এলুম। তারপর লেগে গেল ১৯৩৯-এর লড়াই। সুইটুজারল্যান্ড ছোট্ট দেশ। সীমান্ত রক্ষার জন্য ভোতিয়ের মত ডাক্তারকে উর্দি পারে ব্যারাকে ঢুকতে হল–অবশ্য ডাক্তারের উর্দি। কিন্তু তার এ-দেশে আসাটা আর হয়ে উঠল না।
***
মসিয়ো লুই ভোতিয়ে সুইটুজারল্যান্ডের লেজাঁ নামক স্থানে যে ‘আরোগ্যায়তন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেখানে যক্ষ্মা সারানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শেখানোর অভিনব সমন্বয় বহু সুইজারল্যান্ডবাসীর হৃদয়মন আকৃষ্ট করেছে। তারা অকৃপণ হস্তে এপ্রতিষ্ঠানে অর্থদান করেছেন এবং তাদেরও ইচ্ছা। এ-প্রতিষ্ঠানটি ক্রমে ক্রমে বিশ্বজনের সম্পদ হয়ে উঠুক। কিন্তু উপস্থিত জাতীয়তাবাদ নামে যে বর্বরতা পৃথিবীকে শতধা বিভক্ত করে দিচ্ছে, তার সামনে মসিয়ো ভৌতিয়ে নিরূপায়। তাই আমার বিশ্বাস, যতদিন সুইটজারল্যান্ডে বিশ্বকল্যাণের জন্য সর্বাঙ্গসুন্দর ব্যবস্থা না হয়, ততদিন এ দেশে আমাদেরও চুপ করে বসে থাকা অনুচিত হবে। লেজাঁতে যে প্রতিষ্ঠান সম্ভবপর হয়েছে, এদেশেই বা তা হবে না কেন? বরঞ্চ এদেশে তার প্রয়োজন অনেক বেশি; কারণ এদেশের ছাত্র-সমাজে যক্ষ্মরোগের যে প্রসার তার সঙ্গে অন্য কোন দেশেরই তুলনা হয় না। অম্মদেশীয় যক্ষ্মবৈরী সজ্জন সম্প্রদায় আশা করি কথাটা ভেবে দেখবেন।
কিন্তু এ-হেন গুরুতর বিষয় নিয়ে মাদৃশ অর্বাচীন জনের অত্যধিক বাগাড়ম্বর অশোভনীয়। আমার উচিত, যোগাযোগের ফলে আমার যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছে সেইটে পাঁচজনকে শুনিয়ে দেওয়া। তারপর কে কি করল না করল তা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই।