অর্থাৎ গৃহিণীর ভয়ে আপনি প্রিয়াকে কাফের ঠিকানা দিয়েছেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোন?’
‘আজ্ঞে না। তবে ইউসুফ বে আপনাকে বলতে বলেছেন, তিনি একটু দেরিতে আসবেন। আপনি যেন না যান।’
‘চুলোয় যাক গে ইউসুফ বে। আমি জিজ্ঞেস করছি, চিঠি বা ফোন নেই?’
কাঁচামাচু হয়ে বললে, ‘আজ্ঞে না।’ জানে আজ আপনি দরাজ হাতে বখশিশ, দেবেন না।
‘যাও, চিঠির কাগজ নিয়ে এস।’
কাফের নাম-ঠিকানা-লেখা-উত্তম চিঠির কাগজ, খাম, ব্লটিং প্যান্ড যাবতীয় সাজসরঞ্জাম এক মিনিটের ভিতর উপস্থিত হবে। আপনি পাশের টেবিলে গিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে প্রেমপত্র লিখে যখন ঘণ্টাখানেক পরে আন্ডার টেবিলে ফিরে ওয়েটারকে বলবেন, চিঠিটা ডাকে ফেলতে, তখন হঠাৎ রমজান বে শুধাবে, কাকে লিখলে?’ যেন কিছুই জানে না।
চটে গিয়ে বলবেন, ‘তোমার তাতে কি?’
রমজান বে। উদাস সুরে বলবে, না, আমার তাতে কি। তবু বলছিলুম, সকালে বিলকিসের সঙ্গে দেখা। সে তোমাকে বলে দিতে বললে, তুমি যেন সাড়ে এগারোটায় ‘ফমিনা’ সিনেমার গেটে তার সঙ্গে দেখা করো।’
আরো চটে গিয়ে বলবেন, তাহলে এতক্ষণ ধরে সেটা বলো নি কেন?’
‘সাড়ে এগারোটা বাজতে তো এখনো অনেক দেরি।’
‘আঃ, সে কথা হচ্ছে না। আমি যে মিছিমিছি এক ঘণ্টা ধরে চিঠিটা লিখলুম।’
রমজান বে আরো উদাস সুরে বলবে, জানি নে, ভাই, তোমাদের দেশে প্রেমের রেওয়াজ কি। এদেশে তো জানি, প্রিয়া পাশের ঘরে, আর এঘরে বসে প্রেমিক পাতার পর পাতা প্রেমপত্র লিখে যাচ্ছে।’
এতক্ষণে একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু উপস্থিত হয়। রেশনশপ খোলামাত্ৰই মেয়ে-মদে যে রকম দোকানের ভিতর বাঁপিয়ে পড়ে, তামাম আড্ডা ঠিক সেই রকম প্ৰেমপত্র লেখার সময়-অসমিয়, মোকা-বে-মোকা, কায়দা-কেতা সম্বন্ধে আলোচনা জুড়ে দেবে।
ক্ৰমে ক্রমে আলোচনার বিষয়বস্তু হটতে হটতে পৌঁছবে সেই সনাতন প্রশ্নে, কোন দেশের রমণী সব চেয়ে সুন্দরী হয়।
অবাস্তর নয়, তাই নিবেদন করি, দেশ-বিদেশ ঘুরেছি, অর্থাৎ ভ্যাগাবিন্ড হিসাবে আমার ঈষৎ বদনাম আছে। কাজেই আমাকে কেউ শুধান কোন দেশের রান্না সবচেয়ে ভাল, কেউ শুধান, তুলনাত্মক কাব্যচর্চার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশস্ততম, আর অধিকাংশ শুধান, কোন দেশের রমণী সব চেয়ে সুন্দরী?
আমি কলির পরশুরামের স্মরণে উত্তর দি, ‘এনারা আছেন, ওনারাও আছেন।’ কারণ যাঁরা দেশ-বিদেশ ঘোরেন নি, তাদের সঙ্গে এ আলোচনাটা দানা বাঁধে না, বড্ড একতরফা বক্তৃতার মত হয়ে যায়, আর সবাই জানেন, বক্তৃতা আড্ডার সব চেয়ে ডাঙর দুশমন।
এ সংসারে যদি কোনো শহরের সত্যতার হক্ক থাকে, উপযুক্ত প্ৰাণাভিরাম বিষয় নিয়ে আলোচনা করার তবে কসম খেয়ে বলতে পারি, সে শহর কাইরো। কারণ কাইরোতে খাঁটি বাসিন্দারূপে যুগ যুগ ধরে আছে গ্ৰীক, আরবী, তুর্কী, হাবশী, সুদানী, ইতালিয়, ফরাসিস, ইহুদি। এবং আরো বিস্তর চিড়িয়া। এদের কেউ কেউ বোরখা পরেন বটে, তবু অক্লেশে বলা যেতে পারে, কাফের দরজার দিকে মুখ করে বসে আড্ডা অনায়াসে নিজের মুখে ঝাল খেয়ে নিতে পারে!
আর শীতকাল হলে তো পোয়া বারো। কাইরোতে বছরে আড়াই ফোটা বৃষ্টি হয়, সাহারার শুকনো হাওয়া যক্ষ্মারোগ সারিয়ে দেয়, পিরামিড কাইরোর বাইরেই ঠায় বসে, ফুর্তি-ফার্তির নামে কাইরো বে-এক্তিয়ার, মসজিদ কবর কাইরো শহরে বে-শুমার, শীতকালে না-গরম-না-ঠাণ্ডা আবহাওয়া, সবসুদ্ধ জড়িয়ে-মাড়িয়ে কাঁইরো টুরিস্টজনের ভূস্বৰ্গ এবং টুরিস্টদেরও বটে।
তদুপরি মার্কিন লক্ষপতিরা আসেন নানা ধান্দায়। তাদের সন্ধানে আসেন তাবৎ দুনিয়ার ডাকসাইটে সুন্দরীরা। তাদের সন্ধানে আসেন। হলিউডের ডিরেক্টররা এবং তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসেন আরেক বঁটাক সুন্দরী।
কিন্তু থাক সুশীল পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো, কামিনী-কাঞ্চন সম্বন্ধে আলোচনা শাস্ত্রে নিষেধ। শুরুর বারণ।
***
মিশরী আড্ডাবাজরা (দাঁড়ান, ব্যাকরণে ভুল হয়ে গেল, মিশরী মাত্রই আড্ডাবাজ : এমন কি সাদ জগলুল পাশা পর্যন্ত দিনে অন্তত একবার আড্ডার সন্ধানে বেরোতেন। তবে হাঁ, তিনি কোনো টেবিলে গিয়ে বসলে কেউ সাহস করে সে টেবিলের ত্ৰিসীমানায় ঘেঁষত না। সেখান থেকে তিনি চোখের ইশারায় একে ওঁকে তাঁকে ডেকে নিয়ে আড্ডা জমাতেন) দৈবাৎ একই আড্ডায় জীবন কাটান। বিষয়টা সবিস্তর বুঝিয়ে বলতে হয়।
এই মনে করুন, আপনি রোজ আপিস ফেরার পথে ‘কাফে দা নীলে’র উত্তর-পূর্ব কোণে বসেন। সেই টেবিলটায় আপনার জন-পাঁচেক দোস্ত বসেন। আড়া ফুল ষ্ট্রেনাথ জন দশ-—সবাই কিন্তু সব দিন এ আড্ডাতেই আসেন না। তাই হরে-দরে আপনার টেবিলে জন পাঁচ-সাত নিয়মিত উপস্থিত থাকেন।
এ ছাড়া আপনি সপ্তাহে একদিন—জোর দুদিন, বাড়ির পাশের সেমিরামিস কাফেতে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসেন। এ আড্ডার সদস্যরা কিন্তু আপনার কাফে দ্য নীলের সদস্যদের বিলকুল চেনেন না। এঁরা হয়ত চ্যাংড়ার দল, কলেজে পড়ে, কেরানীগিরি করে, বেকার, কিংবা ইনশিওরেন্স এজেন্ট (তার অর্থও বেকার)। এদের আলোচনার বিষয়বস্তু রাজনীতি, অর্থাৎ কোন পাশার বউ কোন মিনিস্টারের সঙ্গে পরকীয় করেন বলে তাঁর বোনপো পাটিতে ভালো নোকরি পেয়ে গেল, কিংবা আলোচনার বিষয়বস্তু সাহিত্য, অর্থাৎ কোন প্রকাশক একহাজারের নাম করে তিন হাজার ছাপিয়ে বেশ দু’পয়সা কমিয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া অবশ্যই দুনিয়ার হাজারো জিনিস নিয়ে আলোচনা হয়, তা না হলে আড্ডা হবে কেন। এ আড্ডার সদস্যদের সবাই সবজান্তা। এঁরা মিশর তথা তাবৎ দুনিয়ার এত সব গুহ্যু এবং গরম গরম খবর রাখেন যে এদের কথাবার্তা, হাবভাব দেখে আপনার মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে এদের প্রত্যেকের চোখের সামনে এক অদৃশ্য, অশ্রুত টেলিপ্রিন্টার খবর জানিয়ে যাচ্ছে এবং সে খবরের যোগান দিচ্ছেন রাশার বেরিয়া, জার্মানির হিমালয় আর কলকাতার টেগার্ট। রোজ বাড়ি ফেরার সময় আপনি তাজ্জব মানবেন, এদের সাহায্য ছাড়া মিশর তথা দুনিয়ার বাদবাকি সরকারগুলো চলছে কি করে। আপনার মনে আর কোনো সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে না যে, এদের যদি মস্কো, বার্লিন, লন্ডন, দিল্লির বড়কর্তা বানিয়ে দেওয়া হয়, তবে দুনিয়ায় কুল্পে সমস্যার সাকুল্য সমাধান এক লহমায়ই হয়ে যাবে। মনে মনে বললেন, ‘হায় দুনিয়া, তুমি জানছে না। তুমি কি হারাচ্ছে।’