আর যা খুশবাই বেরল তার রেশ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পরও যেন আমার নাকে লেগে আছে।
পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো সুগন্ধী ইজিপশিয়ন সিগারেট ভুবনবিখ্যাত। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি বিশেষ করে মিশরই সুগন্ধী সিগারেট তরিবৎ করে বানাতে শিখল কি করে? আইস সে সম্বন্ধে ঈষৎ গবেষণা করা যাক। এই সিগারেট বানানোর পিছনে বিস্তর ইতিহাস, এস্তার রাজনীতি এবং দেদার রসায়নশাস্ত্ৰ লুক্কায়িত রয়েছে।
সিগারেটের জন্য ভালো তামাক জন্মায় তিন দেশে। আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে, গ্ৰীসের মেসেডোন অঞ্চলে এবং রুশের কৃষ্ণসাগরের পারে পারে। ভারতবর্ষ প্রধানত ভার্জিনিয়া খায়, কিছুটা গ্ৰীক, কিন্তু এই গ্ৰীক তামাক এদেশে টার্কিশ এবং ইজিপশিয়ান নামে প্রচলিত। তার কারণ একদা গ্ৰীসের উপর আধিপত্য করতে তুর্কী এবং তুর্কী গ্ৰীসের বেবাক। তামাক ইস্তাম্বুলে নিয়ে এসে কাগজে পেচিয়ে সিগারেট বানোত। মিশরও তখন তুর্কীর। কন্তুজাতে, তাই তুর্কীর কর্তারা কিছুটা তামাক মিশরে পাঠাতেন। মিশরের কারিগররা সেই গ্ৰীক তামাকের সঙ্গে খাঁটি মিশরের খুশবাই মাখিয়ে দিয়ে যে অনবদ্য রাসনলী নির্মাণ করলেন তারই নাম ইজিপশিয়ান সিগারেট।
নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন চায়ের টিন যদি রান্নাঘরে ভালো করে বন্ধ না রাখা হয়, তবে ফোড়নের বাঁঝে চা বরবাদ হয়ে যায়, অর্থাৎ কিছু না হোক খুশবাইটি আঁতুড়ঘরে নুনখাওয়ানো বাচ্চার মত প্ৰাণত্যাগ করে। মালজাহাজ লাদাই করা যে অফিসারের কর্ম তিনিও বিলক্ষণ জানেন, যে জাহাজে কাঁচা তামাক লাদাই করা হয়েছে তাতে কড়া গন্ধওলা অন্য কোনো মাল নেওয়া হয় না-পাছে তামাকের গন্ধ এবং কিঞ্চিৎ স্বাদও নষ্ট হয়ে যায়।
তাই তামাকের স্বাদ নষ্ট না করে সিগারেটকে খুশবাইয়ে মজানো অতীব কঠিন কর্ম। সিগারেটে একফোঁটা ইউকেলিপটাস তেল ঢেলে সেই সিগারেট ফুঁকে দেখুন, একফোঁটা তেল আস্ত সিগারেট একদম বরবাদ করে দিয়েছে। পাঁচ বছরের বাচ্চাও তখন সে সিগারেট না কেশে অনায়াসে ভস ভস করে ফুঁকে যেতে পারে (বস্তুত বড বেশি ভেজা সর্দি হলে অনেকে এই পদ্ধতিতে ইউকেলিপটাস সেবন করে থাকেন-যারা সিগারেট সইতে পারেন না তারা পর্যন্ত)।
বরঞ্চ এমন গুণী আছেন যিনি এটম বামের মাল-মসলা মেশানোর হাড়হদ্দ হালহকিকৎ জানেন, কিন্তু তামাকের সঙ্গে খুশবাই! তার পিছনে রয়েছে গূঢ়তর রহস্যাবৃত ইন্দ্ৰজাল।
কিচ্ছু বাড়িয়ে বলছি নে। অজন্তার দেওয়াল এবং ছবির রঙ কোন কোন মসলা দিয়ে বানানো হয়েছিল, পাঠানযুগে পাথরে পাথরে জোড়া দেবার জন্য কি মাল কোন পরিমাণে লাগানো হয়েছিল। আমরা সে তত্ত্বগুলো মাথা খুঁড়েও বের করতে পারি নি এবং পারে নি বিশ্বসংসার বের করতে কি কৌশলে, কি মসলা দিয়ে মিশনারীরা মমীগুলোকে পচার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
স্বীকার করি, মিশরীরাই একদিন সে কায়দা ভুলে মেরে দিয়েছিল-পাঠান-মোগল যুগে যে রকম আমাদের অনেকখানি রসায়নবিদ্যা অনাদরে লোপ পায়। তবু তো আমরা আজও মকরধ্বজ, চ্যবনপ্রাশ বানাতে পারি-ভেজাল তো শুরু হল মাত্র সেদিন, আমাদেরই চশমার সামনে!
মিশরীরাও ঠিক সেইরকম সুগন্ধ তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভুলে যায় নি। ঝড়তি-পড়তি যেটুকু এলেম তখনো তাদের পেটে ছিল তাই দিয়ে তারা সেই সমস্যা সমাধান করলো, তামাকে কি করে খুশবাই জোড়া যায়, তামাকের ‘সোয়াদটি জখম না করে।
তাই যখন কোনো ডাকসাইটে তামাক কদরদারের (হায়! এ গোত্র পৃথিবীর সর্বত্র কি কাবুল, কি দিল্লি, কি কাইরো-সুকুমারের ভাষায় বলি-হুশ হুশ করে মরে যাচ্ছে) তদারকিতে কাইরোর কাফেতে তামাক সাজা হয় এবং সেই কদরদার যখন সে তামাকের নীলাভ ধুঁয়োটি ফুরফুর করে নাকের ভিতর দিয়ে ছাড়েন এবং নীলনদের মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া যখন সেই ধুঁয়োটির সঙ্গে রসকেলি করে তাকে ছিন্নভিন্ন করে কাফের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। তখন রাস্তার লোক পর্যন্ত উন্নাসিক হয়ে থমকে দাঁড়ায়, পাঁড় সিগারখেকো, পাইকারি সিগারেট ফোকা পর্যন্ত বুকের উপর হাত রেখে আসমানের দিকে তাকিয়ে অলহমদুলিল্লা’ (খুদাতালার তারিফ) বলে।
আর ইলিশের বেলা যে-রকম হয়েছিল, এ অধম ঠিক সেই রকম তাজ্জব মানে, বেহশতের বর্ণনায় এ তামাকের বয়ান নেই কেন? তা হলে পাপ করে নরকে যেত কোন মূর্খ?
বাঙালি তার চুলটিকে কেতাদুরস্ত করে রাখতে ভালোবাসে, কাবুলী বেলা-অবেলা মোক পেলেই তার পায়জারে গুটিকয়েক পেরেক ঠুকিয়ে নেয়, ইংরেজ আয়না সামনে পেলেই টাইটা ঠিক মধ্যিখানে আছে কিনা তার তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, পেশাওয়ারী পাঠানের প্রধান শিরঃপীড়া তার শিরাভরণ নিয়ে, আর মিশরীর চরম দুর্বলতা তার জুতো জোড়াটিকে ‘বালিশ’ (আরবী ভাষায় ‘প’ অক্ষর নেই, তাই ইংরিজি ‘পালিশ’ কথাটা মিশরীতে ‘বালিশ’ রূপে ধারণ করেছে) রাখার জন্যে।
অতএব কাফেতে ঢোকামাত্রই কাফের ‘বুৎ-বালিশ’ (অর্থাৎ বুট পালিশ করনেওলা) ছোকরা এসে আপনাকে সেলাম ঠুকবে। আপনি তাকে বিলক্ষণ চেনেন, তাই দীতমুখ খিচিয়ে বলবেন, যা, যা’–তার অর্থ ‘আচ্ছা পালিশ কর।’ সে বত্রিশখানা ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে আপনার ‘বুৎ-বালিশ কর্মে নিযুক্ত হবে।
সদস্যদের কেউ বলবেন, ‘শুভ দিবস’, কেউ ‘এই যে, কেউ একটু মৃদু হাস্য করবেন, আর কেউ মুখ খবরের কাগজের আড়ালে রেখেই কাগজখানা ঈষৎ দুলিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যে আপনার কফি এসে উপস্থিত। ওয়েটার ঠিক জানে আপনি কতটা কড়া, কতখানি চিনি আর কোন ঢঙের পেয়ালার কফি খেতে পছন্দ করেন। আপনি বলবেন, চিঠিপত্র নেই?’