আর বাঙলা দেশের তাবৎ চণ্ডীমণ্ডপ, বেবাক জমিদার-হাবেলীর আড্ডার প্রতিভূ হিসেবে আপনাদের আশীর্বাদে আর শ্ৰীগুরুর কৃপায় ধূলির ধূলি এ-অধম।
আমার বাড়ির নিতান্ত গা ঘেঁষে বলে নিছক কফি পানার্থে ঐ কাফেতে আমি রোজ সকাল-সন্ধ্যা যেতুম। বিদেশ-বিভুই, কাউকে বড় একটা চিনি নে, ছন্নের মত হেথা-হোথা ঘুরে বেড়াই আর দেশভ্রমণ যে কি রকম পীড়ামদায়ক ‘প্রতিষ্ঠান’ সে সম্বন্ধে একখানা প্রামাণিক কেতাব লিখব বলে মনে মনে পায়তারা কষি। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল গোল কাফের কোণের আড্ডাটির দিকে। লক্ষ্য করি নি যে কফি-পানটা ওদের নিতান্ত গৌণকর্ম, ওরা আসলে আড্ডাবাজ।
আম্মো যে আডাবাজ সে তত্ত্বটা এদেরও মনে ঝিলিক দিয়ে গেল একই ব্রাহ্মমুহূর্তে। সে ‘মহালগনে’র বর্ণনা আমি আর কি দেব? সুরসিক পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো শ্ৰীহরি শ্ৰীরাধাতে, ইউসুফ জোলেখাতে, লায়লী মজনুতে, ত্রিস্তান ইজোলদেতে কি করে প্রথম চারি চক্ষু বিনিময় হয়েছিল। কী ব্যাকুলতা, কী গভীর তৃষা কী মহা ভবিষ্যতের প্রগাঢ় সুখস্বপ্ন, কী মরুতীর পার হয়ে সুধাশ্যামলিম নীলাম্বুজে অবগাহনানন্দ সে দৃষ্টি-বিনিময়ে ছিল। এক ফরাসি কবি বলেছেন, ‘প্রেমের সব চেয়ে মহান দিবস সেদিন, যেদিন প্রথম বলেছিলুম আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ তত্ত্বটা হৃদয়ঙ্গম হয়। সেই ব্ৰাহ্মা মুহুর্তে।
তাবী-তুলসী-গঙ্গাজল নিয়ে আসুন, স্পর্শ করে বলব, তিন লহমাও লাগে নি, এই ব্রাত্যের উপনয়ন হয়ে গেল, বেদ শাখা ঋষি স্থির হয়ে গেলেন-সোজা বাঙলায় বলে, জাতে উঠে গেলুম। অমিয়া ছানিয়া, নয়ন হানিয়া বললুম, ‘এক রোঁদ কফি?’
আড্ডার মেম্বাররা অএকে অনেয়র দিকে তাকিয়ে পরিতোষের স্মিতহাস্য বিকশিত করলেন। ভাবখানা, ভুল লোককে বাছা হয় নি।
কাফের ছোকরাটা পর্যন্ত ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছে। আমার ছন্নছাড়া ভাবটা তার চোখে বহু পূর্বেই ধরা পড়েছিল। রোঁদ পরিবেশন করার সময় নীলনদ-ডেল্টার মত মুখ হাঁ করে হেসে আমি যে অতিশয় ভদ্রলোক-অর্থাৎ জোর টিপস দি—সে কথাটা বলে আন্ডার সামনে আমার কেস রেকমেন্ড করলো।
জুর্নো তাড়া লাগিয়ে বললেন, ‘যা, যা ছোঁড়া, মেলা জ্যাঠামো করিস নে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খাসা আরবী বলেন আপনি।’
রবিঠাকুর বলেছেন—
‘এত বলি সিক্তপক্ষ্ম দুটি চক্ষু দিয়া
সমস্ত লাঞ্ছনা যেন লাইল মুছিয়া
বিদেশীর অঙ্গ হতে-’
ঠিক সেই ধরনে আমার দিকে তাকিয়ে জুনো যেন আমার প্রবাস-লাঞ্ছনা এক থাবড়ায় ঝেড়ে ফেললেন, আমার অঙ্গ থেকে।
আমি কিন্তু মনে মনে বললুম, ইয়া আল্লা, তেরো দিনের আরবীকে যদি এরা বলে খাসা তবে এরা নিশ্চয়ই খানদানী মনিষ্যি।’ করজোড়ে বললুম, ‘ভারতবর্ষের নীতি, সত্য বলবে, প্রিয় বলবে, অপ্ৰিয় সত্য বলবে না; আপনাদের নীতি দেখছি আরো এক কদম এগিয়ে গিয়েছে, প্রিয় অসত্যও বলবে।’
আড্ডা তো—পালিমেন্ট নয়—তাই হরবকৎ কথার পিঠে কথা চলবে এমন কোনো কসমদিব্যি নেই। দুম করে রমজান বে বললে, ‘আমার মামা (আমি মনে মনে বললুম, ‘যজ্ঞিদাসের মামা’) হজ করতে গিয়েছিলেন আর বছর। সেখানে জনকয়েক ভারতীয়ের সঙ্গে তার আলাপ হয়। তারা নাকি পাঁচ বকৎ নামাজ পড়ত আর বাদবাকি তামাম দিনরাত এক চায়ের দোকানে বসে কিচির-মিচির করত। তবে তারা নাকি কোন এক প্রদেশের—বিঙ্গালা, বাঙালি-কি যেন-আমার ঠিক মনে নেই।–’
উৎসাহে উত্তেজনায় ফেটে গিয়ে চৌচির হয়ে আমি শুধালুম, ‘বাঙালা?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলুম, শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম বাঙালি। কিন্তু কই, কখনো তো এত গর্ব অনুভব করিনি যে, আমি বাঙালি। এই যে নমস্য মহাজনরা মক্কা শহরে আড্ডাবাজ হিসেবে নাম করতে পেরেছেন-নিশ্চয়ই বিশ্ৰী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে—তারা আলবৎ শ্ৰীহট্ট, নোয়াখালি, চাটগা, কাছাড়ের বাঙালি খালাসী, পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতা নগরীর উপকণ্ঠে খিদিরপুরে আড্ডা মারতে শিখে ‘হেলায় মক্কা করিলা জয়’!
আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে ডান হাত বুকের উপর রেখে মাথা নিচু করে অতিশয় সবিনয় কণ্ঠে বললুম, ‘আমি বাঙালি।’
গ্ৰীক সদস্য মার্কোস প্রথম পরিচয়ের সময় একবার মাত্র ‘সালাম আলাইক’ করে। খবরের কাগজের পিছনে ডুব মেরেছিলেন। তাঁর কানে কিছু যাচ্ছিল কি না জানি নে। আমি ভাবলুম রাশভারী লোক, হয়তো ভাবছেন, নূতন মেম্বার হলেই তাঁকে নূতন জামাইয়ের মত কাঁধে তুলে ধেই ধেই করেই নাচতে হবে একথা আড্ডার কনসটিটুৰ্যশানে লেখে না। মুখের উপর থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে বললেন, ‘দাঁও মেরেছি। একটা শ্যাম্পেন্ন হবে? আমাদের নূতন মেম্বার—।’ কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়েছিল মালিক; তার দিকে তাকিয়ে বঁ হাত গোল করে বোতল ধরার মুদ্রা দেখিয়ে ডান হাত দিয়ে দেখালেন ফোয়ারার জল লাফানোর মুদ্রা। ম্যানেজার কুল্লে দুই ডিগ্ৰী কাৎ করে ঘাড় নাড়ল।
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘এ দোকানে তো মদ বেচার লাইসেন্স নেই।’
মার্কোস বললেন, ‘কাফের পেছনে, তার ড্রইংরুমে। ব্যাটা সব বেচে;-আফিম, ককেইন, হেরোইন, হশীশ যা চাও।’
ছোকরাকে বললেন, ‘আর একটা তামাকও সাজিস।’
বলে কি? কাইরোতে তামাক! স্বপ্ন নু মায়া নুমতিভ্ৰম নু?
দিব্যি ফর্শী হাঁকো এল। তবে হনুমানের ন্যাজের মত সাড়ে তিনগজী দরবারি নল নয় আর সমস্ত জিনিসটার গঠন কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা। জরির কাজ করা আমাদের ফর্শী কেমন যেন একটু নাজুক’, মোলায়েম হয়-এদের যেন একটু গাইয়া। তবে হ্যাঁ, চিলিমটা দেখে ভক্তি হল-ইয়া ডাবর পরিমাণ। একপো তামাক হেসেখেলে তার ভিতর থানা গাড়তে পারে-তাওয়াও আছে। আগুনের বেলা অবিশ্যি আমি টিকের ধিকিধিক গোলাপী গরম প্রত্যাশা করি নি, কারণ কাবুলেও দেখেছি টিকে বানাবার গুহ্য তথ্য সেখানকার রসিকরাও জানেন না।