ততক্ষণে আমি একটা খাসা বই পেয়ে গিয়েছি। ন্যূরনবর্গের মোকদ্দমায় যেসব দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গিয়েছিল, তাই দিয়ে গড়া হিটলার চরিত্ৰবৰ্ণন। হিটলার সম্বন্ধে তার দুশমন ফরাসিরা কি ভাবে তার পরিচয় বইখানাতে আছে। এ বইখানার পরিচয় আপনাদের দেব বলে লেখাটা শুরু করেছিলুম, কিন্তু গৌরচন্দ্ৰিকা শেষ হতে না হতেই ভোরের কাক কা-কা করে আমায় স্মরণ করিয়ে দিলে, কলম ‘ফুরিয়ে গিয়েছে। আরেক দিন হবে।
আড্ডা
আড্ডা সম্বন্ধে সম্প্রতি কয়েকটি উত্তম উত্তম লেখা বাঙলায় বেরনোর পর ইংরিজিতেও দেখলুম। আড্ডা হামলা চালিয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপের ভশচায এবং জমিদার-হাবেলির মৌলবী যেন হঠাৎ কোট-পাতলুন-কামিজ পরে গটগট করে স্টেটসম্যান অফিসে ঢুকলেন। আমার তাতে আনন্দই হল।
কিন্তু এ সম্পর্কে একটি বিষয়ে আড়ডার কিঞ্চিৎ বক্তব্য আছে! আড্ডাবাজরা বলতে চান, বাংলার বাইরে নাকি আড্ডা নেই। কথাটা ঠিকও, ভুলও। তুলনা দিয়ে নিবেদন করছি। সিন্ধুনদ উজিয়ে যে মাছ ধরা পড়ে, তার নাম ‘পাল্লা’—অতি উপাদেয় মৎস্য। নর্মদা, উজিয়ে ভরোচ শহরে যে মাছ ধরা পড়ে তার নাম ‘মাদার’—সেও উপাদেয় মৎস্য। আর গঙ্গা পদ্মা উজিয়ে যে মাছ বাঙালিকে আকুল উতলা করে তোলে, তার নাম ইলিশ-খোট্টা (মাফ কীজীয়ে) মুলুকে পৌঁছনর পর তার নাম হয় হিল্সা।
উপযুক্ত সর্ব মৎস্য একই বস্তু–দেশভেদে ভিন্ন নাম। তফাৎ মাত্র এইটুকু যে সরষে বাটা আর ফালি ফালি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আমরা যে রকম ইলিশ দেবীর পুজো দি, বাদবাকিরা ওরকম ধারা পারে না। অর্থাৎ আড্ডা বহু দেশেই আছে, শুধু আমাদের মত তরিবৎ করে রাসিয়ে রসিয়ে চাখতে তারা জানে না। অপিচ ভুললে চলবে না সিন্ধীরা আমাদের সরষেইলিশ খেয়ে নাক সিটিকে বলেন, ‘কী উমদা চীজকে বরবাদ করে দিলে।’ ভূগুকচ্ছের (ভরোচের) মহাজনগণও সিন্ধীর রান্না পাল্লা খেয়ে ‘আল্লা আল্লা’ বলে রোদন করেন।
কে সূক্ষ্ম নিরপেক্ষ বিচার করবে? এ যে রসবস্তু—এবং আমার মতে ভোজনরস সৰ্বরসের রসরাজ।
তাই কইরের আড্ডাবাজরা বলেন, একমাত্র তারা নাকি আড্ডা দিতে জানেন।
কাইরোর আড্ডা ককখনো কোনো অবস্থাতেই কারো বাড়িতে বসে না। আড্ডাবাজরা বলেন তাতে করে আড্ডা নিরপেক্ষতা-কিংবা বলুন গণতন্ত্র-লোপ পায়। কারণ যার বাড়িতে আড্ডা বসলো, তিনি পানটা-আসাটা, খিচুড়িটা, ইলিশ-ভাজটা (আবার ইলিশ! সুশীল পাঠক, ক্ষমা করো। ঐ বস্তুটির প্রতি আমার মারাত্মক দুর্বলতা আছে। বেহেশতের বর্ণনাতে ইলিশের উল্লেখ নেই বলে পাঁচ-বকৎ নামাজ পড়ে সেথায় যাবার কণামাত্র বাসনা আমার নেই)। ফিরি’ দেন বলে তঁকে সবাই যেন একটু বেশি তোয়াজ করে। আড্ডাগোত্রের মিশরী নিকষ্যি মহাশয়রা বলেন, বাড়ির আড্ডায় ‘মেল’ মেলে না।
অপিচ, পশ্য পশ্য, কোনো কাফেতে যদি আড্ডা বসে, তবে সেখানে কেউ কাউকে খয়ের খাঁ বানাতে পারে না—যেন পুরীর মন্দির, জাতফাত নেই, সব ভাই, সব বেরাদর।
এবং সব চেয়ে বড় কথা বাড়ির গিন্নি মুখপোড়া মিনিষেরা ওঠে না কেন’ কখনো শুনিয়ে, কখনো আভাসে ইঙ্গিতে জানিয়ে অকারণে অকালে আড্ডার গলায় ছুরি চালাতে পারেন না। তার চেয়ে দেখো দিকিনি, দিব্যি কাফেতে বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছ, পছন্দমাফিক মমলেট কটলেট খাচ্ছো, আড্ডা জমজমাট ভরভরাট, কেউ বাড়ি যাবার নামটি করছে না, কারো গিন্নি এসে উপস্থিত হবেন সে ভয়ও নেই-আর চাই কি?
শতকরা নব্বই জন কাইরোবাসী আডাবাজ এবং তার দশ আনা পরিমাণ অর্ধেক জীবন কাটায় কাফেতে বসে আড্ডা মেরে। আমাদের আড্ডা বসত ‘কাফে দ্য নীল’ বা ‘নীলনদ ক্যাফেতে’। কফির দাম ছাঁ। পয়সা ফি পাত্তর। রাবাড়ির মত ঘন, কিন্তু দুধ চাইলেই চিত্তির। সবাই কালো কফি খায়, তাই দুধের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিচ্ছ। ঘাবড়াবেন না, দুদিনেই অভ্যাস হয়ে যায়। কালো কফি খেলে রঙভী ফর্সা হয়।
আমাদের আড্ডাটা বসত কাফের উত্তর-পূর্ব কোণে, কাউন্টারের গা ঘেঁষে। হরেক জাতের চিড়িয়া সে আড্ডায় হরবকৎ মৌজুদ থাকত। রমজান বে। আর সজ্জাদ এফেন্দি খাঁটি মিশরী মুসলমান ওয়াহহাব আতিয়া কপ্টা ক্ৰীশচান অর্থাৎ ততোধিক খাঁটি মিশরী, কারণ তার শরীরে রয়েছে ফারাওদের রক্ত। জুর্নে ফরাসি কিন্তু ক’পুরুষ ধরে কাইরোর হাওয়া বিষাক্ত করছে। কেউ জানে না, অতি উত্তম আরবী কবিতা লেখে আর সে কবিতার আসল বক্তব্য হচ্ছে, সে তলওয়ার চালিয়ে আড়াই ডজন বেদুইনকে ঘায়েল করে প্রিয়াকে উটের উপর তুলে মরুভূমির দিগদিগন্ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে, যদিও আমরা সবাই জানতুম, জুর্নো যেটুকু মরুভূমি দেখেছে সে পিরামিডে বেড়াতে গিয়ে, তাও জীবনে একবার মাত্র, যদিও পিরামিড কাইরো থেকে মাত্র পাঁচমাইল দূরে। উট কখনো চড়ে নি, ট্রামের ঝাকুনিতেই বমি করে ফেলে। আর তলওয়ার? তওবা, তওবা! মার্কোস জাতে গ্ৰীক, বেশি নয় কুল্লে আড়াই হাজার বৎসর ধরে তারা মিশরে আছে। মিশর রাণী, গ্ৰীক রমণী ক্লিয়োপাত্রার সঙ্গে তার নাকি খেশ-কুটুম্বিতা আছে। হবেও বা, কারণ প্রায়ই ব্যবসাতে দাঁও মেরেছে বলে ফালতো এবং ফিরি’ এক রোঁদ কফি খাইয়ে দিত। তাতে করে কাফের ‘গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হত না, কারণ মার্কোসকে ‘কটা ফালাইলেও আড্ডার ঝগড়া কাজিয়ায় সে কস্মিনকালেও হিস্যা নিত না; বেশির ভাগ সময় চেয়ারের হেলানে মাথা রেখে আকাশের দিকে হাঁ করে ঘুমুতো কিংবা খবরের কাগজ থেকে তুলোর ফটক বাজারের তেজি-মন্দির (বুল এ্যান্ড বিয়ার) হালহকিকৎ মুখস্থ করতো।