অথবা মনে করুন, দেশে ফেরার সময় আপনি একদিনের তরে কাইরোতে ঢু মেরে এলেন। কিছু কঠিন কর্ম নয়, পোর্ট সাইব্দে জাহাজ থেকে নেমে ট্রেনে কাইরো, সেখানে ঘণ্টা বারো কাটিয়ে মোটরে করে সুয়েজ বন্দরে পৌঁছে ফের সেই জাহাজই ধরা যায়—কারণ জাহাজ সুয়েজ খাল পেরোয় অতি ধীরে ধীরে।
কাইরোতে খেলেন মিশরী রান্না। চাক্তি চাক্তি মাংস খেতে দিল, মধ্যিখানে ছ্যাদা। দাঁতের তলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বটে, কিন্তু সোওয়াদ খাসা। খাচ্ছেন আর ভাবছেন বস্তুটা কি, কিন্তু কোন হদিস পাচ্ছেন না। হঠাৎ মনে পড়ে যাবে, খেয়েছি বটে আমজাদিয়ায় এইরকম ধারা জিনিস-শিককাবাব তার নাম। তবে মশলা দেবার বেলা কঞ্জসী করেছে বলে ঠিক শিককাবাবের সুখটা পেলেন না।
এতক্ষণে আপনার শাস্ত্ৰাধিকার হল। এই যে মশলার তত্ত্বটা আবিষ্কার করতে পেরেছেন, এরই খেই ধরে আপনি রান্নার শ্রেণী বিভাগ নিজেই করে ফেলতে পারবেন।
পৃথিবীতে কুল্লে দুই রকমে রান্না হয়। মশলাযুক্ত এবং মশলাবর্জিত। মশলা জন্মে প্রধানত ভারতবর্ষে, জাভায়, মালয়ে। ইউরোপে মশলা হয় না। তাই ইউরোপীয় রান্না সাধারণত মশলাবর্জিত।
এবার ঈষৎ ইতিহাসের প্রয়োজন। তুর্ক পাঠানরা যখন এদেশে আসে তখন পশ্চিম এবং উত্তর ভারত নিরামিষ খেত। তুর্ক পাঠানরা মাংস খেত বটে, কিন্তু সে রান্নায় মশলা থাকত না। তুর্ক-পাঠান-মোগলরা যে রকম ভারতবর্ষের অলঙ্কার কারুকার্যের সঙ্গে তুর্কিস্থানী ইরানী স্থাপত্য মিলিয়ে তাজমহল বানালো, ঠিক সেইরকম ভারতীয় মশলার সঙ্গে তাদের মাংস রান্নার কায়দা মিলিয়ে এক অপূর্ব রান্নার সৃষ্টি করল। আপনারা তাজমহল দেখে আহা ‘আহা।’ করেন, আমি করি না। কারণ তাজমহল চিবিয়ে খাওয়া যায় না। আর খাস মোগলাই রান্না পেলেই আমি খাই এবং খেয়ে জিন্দাবাদ বাবুর আকবর’ বলি-যদিও তারা বহুকাল হল এ-জিন্দেগীর খাওয়াদাওয়া শেষ করে চলে গিয়েছেন।
***
এই ‘মোগলাই রান্না ক্ৰমে ক্ৰমে ভারতবর্ষের তাবৎ মাংস-খেকোদের ভিতর ছড়িয়ে পড়ে। (বাঙালি আর দ্রাবিড়ের কথা আলাদা; এরা মাংস খায় কম, আর খাস মোগলপাঠানের সংস্পর্শে এসেছে তারও কম। পিরালী ঠাকুরবাড়ি ব্যত্যয়, তারা মোগলের সঙ্গে খানিকটা মিশেছিলেন বলে তাঁদের রান্নায় বেশ মোগলাই খুশবাই পাওয়া যায়)। এমন কি মোগলের দুশমন রাজপুত মারাঠারা পর্যন্ত মোগলাই খেতে আরম্ভ করল। এখনো রাজপুতানা, বরোদা, কোল্হাপুর রাজ্যের সরকারি অতিথিশালায় উঠলে বাবুর্চি প্রথম দিনই শুধায় ‘মোগলাই’ না নিরামিষ খাবে। আমার উপদেশ–মোগলাইটাই খাবেন–তাতে করে পরজন্মে অজ-শিশু হয়ে জন্মালেও আপত্তি নেই।
মোগল-পাঠানরা এই রান্না আফগানিস্থান-তুর্কীস্থানে প্রচলিত করল। আস্তে আস্তে সেই রান্নাই তাবৎ মধ্যপ্রাচ্য ছেয়ে ফেলল। তবে যত পশ্চিম পানে যাবেন, ততই মশলার মেকদার কমে আসবে। অর্থনীতিতে নিশ্চয়ই পড়েছেন, উৎপত্তিস্থল থেকে কোন বস্তু যতদূরে যাবে ততই তার দাম বেড়ে যায়। আফগানিস্থানের রান্নায় যে, হলুদ (কাবুলীরা বলে ‘জীরদ চোপ’ অর্থাৎ হলদে কাঠ) পাবেন, ইস্তাম্বুল পর্যন্ত সে হলুদ পৌঁছয় নি।
তুর্করা বল্কান জয় করে, হাঙ্গেরি পেরিয়ে ভিয়েনার দরজায় হানা দেয়। হাঙ্গেরিতে মোগলাই মাংসের ঝোল ‘হাঙ্গেরিয়ান গুলাশে’ পরিবর্তিত হল এবং মিশরী এবং তুর্কদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ভেনিসের কারবারীরা মিনসট-মীটে’র পোলাও বা রিসোত্তো বানাতে শিখল। গ্ৰীস সেদিন পর্যন্ত তুর্কীর তীব্বেতে ছিল, তাই গ্ৰীসের পোশাকী রান্না আজও চেগা-চাপকন পরে থাকে।
পৃথিবীতে দ্বিতীয় উচ্চাঙ্গের রান্না হয়। প্যারিসে কিন্তু মশলা অতি কম, যদিও ইংরেজি রান্নার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। এককালে তামাম ইয়োরোপ ফ্রান্সের নকল করত, তাই বন্ধান গ্ৰীসেও প্যারিসি রান্না পাবেন। গ্ৰীস উভয় রান্নার সঙ্গমস্থল। বাকি জীবনটা যদি উত্তম আহারাদি করে কাটাতে চান, তবে আস্তানা গাড়ন গ্ৰীসে (দেশটা বেজায় সস্তা)। লঞ্চ, ডিনার, সাপার খাবেন ফরাসী মোগলাই এবং ঘরোয়া গ্ৰীক কায়দায়। ভূড়ি কমাবার কোমরবন্দ সঙ্গে নিয়ে যাবেন—গ্ৰীসে এ জিনিসের বড় বেশি চাহিদা বলে বস্তুটা বেজায় আক্রা।
সুশীল পাঠক, স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনি অতিষ্ট হয়ে উঠছেন। আপনার মনে আঁকুবাবু প্রশ্ন, রান্না-জগতে বাঙালির অবদান কি?
আছে, আছে। মাছ, ছানা এবং বাঙালি বিধবার নিরামিষ রান্না।
কিন্তু তার আগে তো চীনা রান্নার বয়ান দিতে হয়। মোগলাই, ফরাসী এবং চীনা এই ত্রিমূর্তির বর্ণনা না করে আমি ‘প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা’র প্রশ্রয় দিতে চাইনে।
আরেকদিন হবে। বৈদ্যরাজ বলেছেন, দীর্ঘজীবী হয়ে যদি বহুকাল ধরে উদরামার্গের সাধনা করতে চাও, তবে বীজমন্ত্র হচ্ছে জীৰ্ণে ভোজনং’। অর্থাৎ হজম না করা পর্যন্ত পুনরায় আর বসবে না। তাও যদি না মানেন, তবে চটে গিয়ে সুকুমার রায়ের ভাষায় বলব (দোষটা তীর, কটু বাক্যটা তিনিই কয়েছেন)–
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা।
খাও তবে কচু পোড়া, খাও তবে ঘণ্টা।
ইউরোপে ভারতীয় শাস্ত্র-চর্চা
সুইটজারল্যান্ডের মত দেশেও লোকে সংস্কৃত পড়ে, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সুইসদের কৌতূহলও আছে—যদিও সে দেশে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়ানো হয় ও তাতে সংস্কৃতের অধ্যাপক কুল্লে একজনই। সেই অধ্যাপকটি এসেছেন এদেশে—সেদিন দেখা হল এখানে। অমায়িক লোক, চেহারাটি খাবসুরৎ, ইংরেজি বলেন ভাঙা-চাঙা, নিজের ভুলে নিজেই হেসে ওঠেন। ভারতবর্ষের নীল আকাশ, সোনালি রোদ আর সবুজ ঘাসের যা তারিফ করলেন তা শুনে আমি লাজুক হাসি হেসে হ্যা, হ্যাঁ’ করে গেলুম, এমনি কায়দায় যেন ওগুলো নিতান্ত আমারই হাতে গড়া, এগজিবিশনে ছেড়েছি, দু’চার পয়সা পেলে বিক্রি করতেও রাজী আছি। সুইটজারল্যান্ডের পাল্টা প্রশংসাও করলুম, আহা, কী চমৎকার শাদা বরফ, নীল সরোবর আর চকচকে ঝকঝকে বাড়িঘরদোর।‘ সায়েব হাসিমুখে অনেক ধন্যবাদ দিলেন।