Gesundheitswiederherstellungsmittelzusammen mischungverhaeltnisskundiger.
টুকরো টুকরো করলে অর্থ হয়; ‘স্বাস্থ্যু’, ‘পুনরায় দান’, ‘সর্বভেষজ’, ‘একসঙ্গে মেশানোর তত্ত্বজ্ঞান’। একুনে হবে ‘স্বাস্থ্যপুনরাদানসৰ্বভৈষজসংমিশ্রণশাস্ত্ৰজ্ঞ’।
(সমাসটায় কোনো ভুল থেকে গেলে বিদগ্ধ পাঠক বিরক্ত হবেন না–আমার সংস্কৃতজ্ঞান ‘নিত্যসা ফতেন’ জাতীয়)।
সংস্কৃত ভাষা সমাস বানানোতে সুপটু, সে-কথা আমরা সবাই জানি এবং প্রয়োজনমতো আমরা সংস্কৃত থেকে সমাস নিই, কিন্তু নতুন সমাস যদি বা আমরা বানাই তবু কেমন যেন আধুনিক বাংলায় চালু হতে চায় না। আলোকচিত্র’, ‘যাদুঘর’, ‘হাওয়াগাড়ি’ কিছুতেই চললো না।-ইংরিজি কথাগুলোই শেষপর্যন্ত ঠেলে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসন জাঁকিয়ে বসলো। দ্বিজেন্দ্ৰনাথ নির্মিত automobile কথার স্বতশ্চলশকট’ সমাসটা চালানোর ভরসা আমরা অবশ্য কোনো কালেই করি নি।
বিশেষ করে এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এ প্রস্তাবটি আমি উত্থাপন করেছি—এবং এতক্ষণ ধরে তারই পটভূমিকা নির্মাণ করলুম।
ভাষাকে জোরালো করার জন্য যে অকাতরে বিদেশী শব্দ গ্ৰহণ করতে হয়, সেকথা অনেকেই মেনে নেন, কিন্তু আপন ভাষারই দুটো কিংবা তারও বেশি শব্দ একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে যে তৃতীয় শব্দ নির্মাণ করে ভাষার শব্দভাণ্ডার বাড়ানো যায় সে দিকে সচরাচর কারো খেয়াল যায় না।
এই সমাস বাড়ানোর প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা কোনো কোনো ভাষার নেই। ইংরিজি ফরাসি কেঁদে-কুকিয়ে দৈবাৎ দু’একটা সমাস বানাতে পারে–যথা হাইব্রাও’, ‘রাব্দেভু’। এ প্রবৃত্তি যে ভাষার নেই, তার ঘাড়ে এটা জোর করে চাপানো যায় না।
বাংলার আছে, কিন্তু মরমর। এখানে শুদ্ধ সংস্কৃত সমাসের কথা হচ্ছে না-সে তো আমরা নিইই—আমি খাঁটি বাংলা সমাসের কথা ভাবছি। হুতোমের আমলেও অশিক্ষিত বাঙালি খাঁটি বাঙলা শব্দ দিয়ে খাস সমাস বানাতো। মেছুনি ডাকছে, ‘ও-’গামছা-কেঁধে’, দাঁড়া, ঐ হোথায় খ্যাংরা-গোপো’ তোর সঙ্গে কথা কইতে চায়।’
একেই বলে সমাস! চট করে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
কিন্তু আজকালকার লেখকেরা এরকম সমাসের দিকে নজর দেন না, নতুন সমাস গড়বার তকলিফ বরদাস্ত করতে তো তারা বিলকুল নারাজ বটেনই। সমাস বানাবার প্রবৃত্তিটা অনাদরে ক্রমেই লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কারণ লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকেরা যদি দিশী সমাসকে আপন লেখনে স্থান না দেন, তবে ক্ৰমে ক্ৰমে গোটা প্রবৃত্তিটা বেমালুম লোপ পায়-যে–রকম। বাউল-ভাটিয়ালী সাহিত্যিকদের কাছে সম্মান পাচ্ছে না বলে ক্ৰমেই উপে যাচ্ছেপরে যখন কুঁশ হয় ততদিনে ভাষায় লড়াইয়ের একখানা উমদা-সে উমদ হাতিয়ার অবহেলায় মর্চে ধরে শেষ হয়ে গেছে। তখন শুধু মাথা-চাপড়ানো আর কান্নাকাটি।
রবীন্দ্রনাথ এ তত্ত্বটা শেষ বয়সে বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই শেষ রাতেই ওস্তাদের মারা দেখিয়ে গিয়েছেন :—
‘ডাকছে থাকি থাকি
ঘুমহারা কোন ‘নাম-না-জানা’ পাখি,
দক্ষিণের ‘দোলা-লাগা’, ‘পাখি-জাগা’
বসন্ত প্ৰভাতে’
তাই বলি বাঙলা ভাষা লক্ষ্মীছাড়া’, ‘হতভাগা’ নয়! শুধু হাতির মত আমরা নিজেদের তাগাদ জানি নে।
আহারাদি
যে লোক উদ্ভিদতত্ত্ব জানে না, সে দেশী-বিদেশী যে-কোন গাছ দেখলেই মনে করে, এও বুঝি এক সম্পূর্ণ নূতন গাছ। তখন নূতন গাছের সঙ্গে তার চেনা কোনো গাছের কিছুটা মিল সে যদি দেখতে পায়। তবে অবাক হয়ে ভাবে, এই চেনা-অচেনায় মেশানো গাছের কি অন্ত নেই। কিন্তু শুনেছি, উদ্ভিদ-বিদ্যা নাকি পৃথিবীর বেবাক গাছকে এমন কতকগুলো শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলেছে যে, নূতন কোনো গাছ দেখলে তাকে নাকি কোনো একটা শ্রেণীতে ফেলে নামকরণ পর্যন্ত করা যায়। আশ্চর্য নয়, কারণ ধ্বনির বেলা তো তাই দেখতে পাচ্ছি। ইংরিজি শুনে মনে হয় যে, এই বিকট ভাষায় স্বর-ব্যঞ্জনের বুঝি অন্ত নেই। কিন্তু ডেনিয়েল জোনস এবং পূর্বাচার্যগণ এমনি উত্তম শ্রেণীবিভাগ করে ফেলেছেন যে, আজ আমরা বাপঠাকুরদার চেয়ে বহু কম মেহন্নতে ইংরিজি উচ্চারণ শিখতে পারি।
আহারাদির বেলাও তাই। আপনার হয়ত কোনো কাবুলীওয়ালার সঙ্গে মিতালি হল। সে আপনাকে দাওয়াত করে খাওয়াল। প্রথমটায় আপনি হয়ত ভেবেছিলেন যে, হাতুড়ি বাটালি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে দেখেন, খেতে দিল তোফা পোলাও আর খাসা মুরগীর ঝোল। তবে ঠিক জাকারিয়া স্ট্রীটের মত রান্না নয়, কলকাতাবাসী পশ্চিমা মুসলমানরা যে রকম রান্না করে ঠিক সে রকম নয়। কেমন যেন একটুখানি আলাদা, কিন্তু খেতে উমদা।
অথবা মনে করুন। আপনাকে প্যারিসের কোনো রেস্তোরাঁয় আপনার ভারতীয় বন্ধু হাঙ্গেরিয়ান গুলশ খেতে দিলেন। হয়তো আপনি ইয়োরোপে এসেছেন মাত্র কয়েকমাস হল—নানা প্রকার যাবনিক খাদ্য খেয়ে খেয়ে আপনার পিত্তি (উভয়ার্থে) চটে আছে। তখন সেই ‘গুলাশ’ দেখে আপনি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবেন। সেই রাত্রেই আপনি গিন্নিকে চিঠি লিখলেন, ‘বহুকাল পরে মাংসের ঝোল খেয়ে বিমলানন্দ উপভোগ করলুম।’ কারণ হাঙ্গে রিয়ান গুলাশ’ আর সাদা-মাটা মাংসের ঝোলে কোনো তফাৎ নেই।
আর আপনার বন্ধু যদি ন’সিকে গুণী হন এবং সেই গুলাশের সঙ্গে খেতে দেন ইতালিয়ান রিসোত্তো’, তাহলে আপনাকে হাতি দিয়ে বেঁধেও সেই রেস্তোরা থেকে বের করা যাবে না। ইয়োরোপের বাকি কটা দিন আপনি সেই রেস্তোরার টেবিল বেড়ালছানার মত আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চাইবেন। কারণ বহুকাল যাবনিক আহারাদির পর মাংসের ঝোল আর রুটি মুখরোচক বটে, কিন্তু তার সঙ্গে কি পোলাও আর মাংসের ঝোলের তুলনা হয়? ঘড়েল পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন যে, ইতালিয়ান রিসোত্তো’ মানে পোলাও, তবে ঠিক, ভারতীয় পোলাও নয়। কোপ্তা-পোলাওয়ের কোপ্তাগুলোকে যদি ছোট্ট ছোট্ট টুকরো করে পোলাওয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাই হবে রিসোত্তো।