‘কত দূর-দরাজ থেকে সে-মিনার দেখা যায়, সে আপনি জানেন, আমিও জানি সমীরুদ্দীও জানে।’
মিনার না দেখতে পেয়ে সমরুদী আশ্চর্য হয়ে গেল, তারপর ক্ৰমে ক্রমে এগিয়ে দেখে—কোথায় দিঘি, কোথায় টাইলের টঙি ঘর!’
আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালাম, ‘সে কী কথা!’
সারেঙ যেন আমার প্রশ্ন শুনতে পায় নি। আচ্ছন্নের মত বলে যেতে লাগল, ‘কিছু না, কিছু না, সেই পুরনো ভাঙা খড়ের ঘর, আরও পুরনো হয়ে গিয়েছে। যেদিন সে বাড়ি ছেড়েছিল, সেদিন ঘরটা ছিল চারটা বাঁশের ঠেকনায় খাড়া, আজ দেখে ছটা ঠেকনা। তবে কি ছোট ভাই বাড়ি-ঘরদের গায়ের অন্য দিকে বানিয়েছে? কই, তা হলে তো নিশ্চয়ই সেকথা কোন-না-কোন চিঠিতে লিখত। এমন সময় দেখে গায়ের বাসিত মোল্লা। মোল্লাজী আমাদের সবাইকে বড় প্যার করে। সমীরুদীকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
‘প্রথমটায় তিনিও কিছু বলতে চান নি। পরে সমীরুদ্দীর চাপে পড়ে সেই ধানক্ষেতের মধ্যিখানে তাকে খবরটা দিলেন। তার ভাই সব টাকা ফুঁকে দিয়েছে। গোড়ার দিকে শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, মৌলবীবাজারে, শেষের দিকে কলকাতায়—ঘোড়া, মেয়েমানুষ আরও কত কী?’
আমি থাকতে না পেরে বললুম, ‘বল কী সারেঙ! এ-রকম ঘা মানুষ কি সইতে পারে? কিন্তু বল দিকিনী, গায়ের কেউ তাকে চিঠি লিখে খবরটা দিলে না কেন?’
সারেঙ বললে, ‘তারাই বা জানবে কি করে, সমীরুদী কেন টাকা পাঠাচ্ছে। সমীরুদীর ভাই ওদের বলেছে, বড় ভাই বিদেশে লাখ টাকা কামায়, আমাকে ফুর্তি-ফার্তির জন্য তারই কিছুটা পাঠায়। সমীরুদ্দীর চিঠিও সে কাউকে দিয়ে পড়ায় নি—সমীরুদ্দি নিজে আমারই মত লিখতে পড়তে জানে না, কিন্তু হারামজাদা ভাইটাকে পাঠশালায় পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। তবু মোন্নাজী আর গায়ের পাঁচজন তার টাকা ওড়াবার বহর দেখে তাকে বাড়িঘরদের বাঁধতে, জমি-খামার কিনতে উপদেশ দিয়েছিলে। সে নাকি উত্তরে বলেছিল, বড় ভাই বিয়ে শান্দি করে মিরকিন মুলুকে গোরস্থালী পেতেছে, এ দেশে আর ফিরবে না, আর যদি ফেরেই বা, সঙ্গে নিয়ে আসবে লাখ টাকা। তিন দিনের ভিতর দশখানা বাড়ি হাঁকিয়ে দেবে।’
আমি বললুম, ‘উঃ! কী পাষণ্ড! তারপর?’
সারেঙ বললে, সমীরুদী আর গায়ের ভিতর ঢেকে নি। সেই ধানক্ষেত থেকে উঠে ফিরে গেল। আবার শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে। সমীরুদী আমাকে বলে নি কিন্তু মোল্লাজী নিশ্চয়ই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু সে ফেরে নি। শুধু বলেছিল, যেখান থেকে এয়েছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।
নিয়ে এলেন স্টেশনে—টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে সে গায়েই ছিল। সমীরুদ্দীর দু পা জড়িয়ে ধরে সে মাপ চেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে। আরও পাঁচজন বললেন, বাড়ি চল, ফের মিরকিন যাবি তো যাবি, কিন্তু এতদিন পরে দেশে এসেছিস, দুদিন জিরিয়ে যা।’
আমি বললুম, ‘রাস্কেলটা কোন মুখ নিয়ে ভাইয়ের কাছে এল সারেঙ?’
সারেঙ বললে, ‘আমিও তাই পুছি। কিন্তু জানেন সায়েব, সমীরুদী কী করলে? ভাইকে লাথি মারলে না, কিছু না, শুধু বললে সে বাড়ি ফিরে যাবে না।
‘তার পরদিন ভোরবেলা এই জাহাজে তার সঙ্গে দেখা। আপনাকে তো বলেছি, শাবন্দরের বারুণীর পুতুলের মত চুপ করে বসে।’
দম নিয়ে সারেঙ বললে, ‘অতি অল্প কথায় সমীরুদী আমাকে সব কিছু বলেছিল। কিন্তু হুজুর, শেষটায় সে যা আপন মনে বিড়বিড় করে বলেছিল, তার মানে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। তবে কথাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে বলেছিল, ‘ভিখিরি স্বপ্নে দেখে সে বড়লোক হয়ে গিয়েছে, তারপর ঘুম ভাঙতেই সে দেখে সে আবার দুনিয়ায়। আমি দেশে টাকা পাঠিয়ে বাড়ি ঘরদোর বানিয়ে হয়েছিলাম বড়লোক, সেই দুনিয়া যখন ভেঙে গেল তখন আমি গোলাম কোথায়?’
বাস্তব ঘটনা না হয়ে যদি শুধু গল্প হত, তবে এইখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু আমি যখন যা শুনেছি তাই লিখছি তখন স্যারেঙের বাদবাকি কাহিনী না বললে অন্যায় হবে।
সারেঙ বললে, ‘চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমার সর্বক্ষণ মনে হয় যেন কাল সাঁঝে সমীরুদ্দী আমার কেবিনের অন্ধকার তার ছাতির খুন ঝরিয়েছিল।
‘কিন্তু ওই যে ইনসাফ বললেন না হুজুর তার পাত্তা দেবে কে?’
সমীরুদী মিরকিন মুলুকে ফিরে গিয়ে দশ বছরে আবার তিরিশ হাজার টাকা কামায়। এবারে আর ভাইকে টাকা পাঠায় নি। সেই ধন নিয়ে যখন দেশে ফিরছিল তখন জাহাজে মারা যায়। ত্রিসংসারে তার আর কেউ ছিল না বলে টাকাটা পৌঁছল সেই ভাইয়েরই কাছে। আবার সে টাকাটা ওড়াল।’
ইনসাফ কোথায়?
নোনামিঠা
ব্যারোমিটার দেখে, কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, লাল-দরিয়া এমন কিছু গরম জায়গা নয়। জেক্কাবাদ পেশওয়ার দূরে থাক, যাঁরা পাটনা-গয়ার গরমটা ভোগ করেছেন তারা আবহাওয়া-দপ্তরে তৈরি লাল-দরিয়ার জন্ম-কুণ্ডলী দেখে বিচলিত তো হবেনই না, বরঞ্চ ঈষৎ মৃদু হাস্যও করবেন। আর উন্নাসিক পর্যটক হলে হয়তো প্রশ্ন করেই বসবেন, হালকা আলসটারটার দরকার হবে না তো!’
অথচ প্রতিবারেই আমার মনে হয়েছে, লাল-দরিয়া আমাকে যেন পার্ক সার্কাসের হোটেলে খোলা আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শিক-কাবাব ঝলসাচ্ছে। ভুল বললুম, মনে হয়েছে, যেন হাঁড়িতে ফেলে, ঢাকনা লেই দিয়ে সেঁটে আমাকে দম-পুখতের’ রান্না বা ‘পুটপঙ্ক’ করেছে। ফুটবলীদের যে রকম ‘বগি-টিম’ হয়, লাল-দরিয়া আমার ‘বগি-সী।’
সমস্ত দিনটা কাটাই জাহাজের বৈঠকখানায় হাঁপাতে হাঁপাতে আর বরফভর্তি গেলাসটা কপালে ঘাড়ে নাকে ঘষে ঘষে, আর রাতের তিনটে যামই কটাই রকে অর্থাৎ ডেকে তারা গুনে গুনে। আমার বিশ্বাস ভগবান লাল-দরিয়া গড়েছেন। চতুর্থ ভূতকে বাদ দিয়ে। ওর সমুদ্রে যদি কখনও হাওয়া বয় তবে নিশ্চয়ই কিম্ভুতই বলতে হবে।