বলল বটে হক কথা, তবু সারেঙের চোখেও এক ফোঁটা নোনা জল দেখা দিল।
সারেঙ বললে, যাক সে কথা। এ সাত বছর মাঝে মাঝে এর মুখ থেকে ওর মুখ থেকে খবর কিংবা গুজব, যাই বলুন, শুনেছি, সমীরুদী বহুত পয়সা কমিয়েছে, দেশেও নাকি টাকা পাঠায়, তবে সে আস্তানা গেড়ে বসেছে মিরকিন মুলুকে, দেশে ফেরার কোন মতলব নেই। তাই নিয়ে আমি আপসোস করি নি, কারণ খুদাতালা যে কার জন্য কোন মুলুকে দানাপানি রাখেন, তার হদিস বাতিলাবে কে?
‘তারপর কল-ঘরের তেলে-পিছল মেঝেতে আছাড় খেয়ে ভেঙে গেল আমার পায়ের হাডি। বড় জাহাজের কম ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসে ঢুকলাম ডিসপ্যাঁচারের কামে। এজাহাজে আসার দুদিন পরে, একদিন খুব ভোরবেলা ফজরের নমাজের ওজু করতে যাচ্ছি, এমন সময় তাজ্জব মেনে দেখি, ডেকে বসে রয়েছে সমীরুদ্দী! বুকে জীবড়ে ধরে তাকে বললাম, ভাই সমীরুদ্দী! এক লহমায় আমার মনে পড়ে গেল, সমীরুদীকে এককালে আমি আপনার ভাইয়ের মতন কতই না প্যার করেছি।
‘কিন্তু তাকে হঠাৎ দেখতে পাওয়ার চেয়েও বেশি তাজ্জব লাগিল আমার, সে আমার প্যারে কোন সাড়া দিল না বলে। গাঙের দিকে মুখ করে পাথরের পুতুলের মত বসে রইল সে। শুধালাম, ‘তোর দেশে ফেরার খবর তো আমি পাই নি। আবার এ জাহাজে করে চলেছিস তুই কোথায়? কলকাতা? কেন? এদেশে মন টিকল না?’
‘কোন কথা কয় না। ফকির-দরবেশের মত বসে রইল ঠিায়, তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে, যেন আমাকে দেখতেই পায় নি।
‘বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তখনকার মত তাকে আর কথা কওয়াবার চেষ্টা না করে, ঠেলোঁঠুলে কোন গতিকে তাকে নিয়ে গেলাম। আমার কেবিনে। নাশতার পেলেট সামনে ধরলাম, আণ্ডা ভাজা ও পরটা দিয়ে সাজিয়ে-ওই খেতে সে বড় ভালবাসতকিছু মুখে দিতে চায় না। তবু জোর করে গেলালাম, বাচ্চাহারা মাকে মানুষ যে রকম মুখে খাবার ঠেসে দেয়, কিন্তু হুজুর, পরের জন্য অনেক কিছু করা যায়, জানতক কুরবানি দিয়ে তাকে বাঁচানো যায়, কিন্তু পরের জন্য খাবার গিলি কী করে?
‘সেদিন দুপুরবেলা তাকে কিছুতেই গোয়ালন্দে নামতে দিলাম না। আমার, হুজুর, মনে পড়ে গেল বহু বৎসরের পুরনো কথা-নুউক বন্দরেও আমাদের নামতে দেয় নি, তখন সমীরুদী সেখানেই গায়েব হয়েছিল।
‘রাত্রের অন্ধকারে সমীরুদীর মুখ ফুটিল।
‘হঠাৎ নিজের থেকেই বলতে আরম্ভ করল, কী ঘটেছে।’
সারেঙ দম নেবার জন্য না অন্য কোন কারণে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল বুঝতে পারলুম না। আমিও কোন খোঁচা দিলুম না। বললে, ‘তা সে দুঃখের কাহিনী—ঠিক ঠিক বলি কী করে সাহেব? এখনও মনে আছে, কেবিনের ঘোরাঘুটি অন্ধকারে সে আমাকে সবকিছু বলেছিল। এক-একটা কথা যেন সে অন্ধকার ফুটো করে আমার কানে এসে বিন্ধেছিল, আর অতি অল্প কথায়ই সে সব কিছু সেরে দিয়েছিল।
‘সাত বছরে সে প্রায় বিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল দেশে তার ছোট ভাইকে। বিশ হাজার টাকা কতখানি হয়, তা আমি জানি নে, একসঙ্গে কখনও চোখে দেখি নি-’
আমি বললুম, ‘আমিও জানি নে, আমিও দেখি নি।’
‘তবেই বুঝুন হুজুর, সেটাকা কামাতে হলে কটা জানি কুরবানি দিতে হয়।
‘প্ৰথম পাঁচশো টাকা পাঠিয়ে ভাইকে লিখলে, মহাজনের টাকা শোধ দিয়ে বাড়ি ছাড়াতে। তার পরের হাজার দেড়েক বাড়ির পাশের পতিত জমি কেনার জন্য। তারপর আরও অনেক টাকা দিঘি খোদাবার জন্য, তারপর আরও বহুত টাকা শহুরী ঢঙে পাকা চুনকাম করা দেয়াল-ওলা টাইলের চারখানা বড় ঘরের জন্য, আরও টাকা ধানের জমি, বলদ, গাই, গোয়ালঘর, মরাই, বাড়ির পিছনে মেয়েদের পুকুর, এসব করার জন্য এবং সর্বশেষে হাজার পাঁচেক টাকা। টঙি ঘরের উল্টোদিকে দিঘির এপারে পাকা মসজিদ বানাবার জন্য।
‘সাত বছর ধরে সমীরুদী মিরকিন মুলুকে, অসুরের মত খেটে দু শিফটু আড়াই শিফ্টে গতর খাটিয়ে জান পানি করে পয়সা কামিয়েছে, তার প্রত্যেকটি কড়ি হালালের রোজাকার, আর আপন খাই-খরচার জন্য সে যা পয়সা খরচ করেছে, তা দিয়ে মিরকিন মুলুকের ভিখারিরও দিন গুজরান হয় না।
‘সব পয়সা সে ঢেলে দিয়েছে বাড়ি বানাবার জন্য, জমি কেনার জন্য। মিরকিন মুলুকের মানুষ যে-রকম চাষবাসের খামার করে, আর ভদ্রলোকের মত ফ্যাশানের বাড়িতে থাকে, সে দেশে ফিরে সেই রকম করবে বলে।
‘ওদিকে ভাই প্ৰতি চিঠিতে লিখেছে, এটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে-করে করে যেদিন সে খবর পেল মসজিদ তৈরি শেষ হয়েছে, সেদিন রওয়ানা দিল দেশের দিকে। নুউক বন্দরে জাহাজে কাজ পায় আনাড়ী কালা আদিমও বিনা তাকলিফে। তার ওপর সমীরুদী হরেক রকম কারখানার কাজ করে করে কলকব্জা এমনি ভাল শিখে গিয়েছিল যে, তারই সার্টিফিকেতের জোরে, জাহাজে আরামের চাকরি করে ফিরল খিদিরপুর। সন্ধ্যের সময় জাহাজ থেকে নেমে সোজা চলে গেল শেয়ালদা। সেখানে প্লাটফর্মে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে চাটগাঁ মেল ধরে শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছল রাত তিনটোয়। সেখান থেকে হেঁটে রওয়ানা দিল ধলাইছড়ার দিকে—আট মাইল রাস্তা, ভোর হতে না-হতেই বাড়ি পৌঁছে যাবে।
‘রাস্তা থেকে পোয়াটাক মাইল ধানক্ষেত, তারপর ধলাইছড়া গ্রাম। আলোর উপর দিয়ে গ্রামে পৌঁছতে হয়।
‘বিহানের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে সমীরুদী পৌঁছল ধানক্ষেতের মাঝখানে।
‘মসজিদের একটা উঁচু মিনার থাকার কথা ছিল—কারণ মসজিদের নকশাটা সমীরুদীকে করে দিয়েছিলেন এক মিশরী ইঞ্জিনিয়ার, আর হুজুরও মিশর মুলুকে বহুকাল কাটিয়েছেন, তাদের মসজিদে মিনারের বাহার হুজুর দেখেছেন, আমাদের চেয়ে ঢের বেশি।